নাপিত এবার তার তৃতীয় ভাইয়া বাকবক-এর কিস্সা শুরু
করল—‘জাঁহাপনা, আমার তৃতীয় ভাইয়া বাগদাদ নগরের
ভিখারীদের দলের সর্দার। সে একেবারেই অন্ধ। মোটেই চোখে
দেখে না। একদিন সে এক আমীরের বাড়ির দরজায় ভিক্ষার জন্য
হাজির হ'ল।
তার ভিক্ষা চাওয়ার কৌশদ ভারি চমৎকার মুখে বলবে না.
‘ভিক্ষা দাও গো'। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র বলবে—'কই
গো, কেউ আছে নাকি?
কড়ির লোক দরজা খোলার আগে জিজ্ঞেস করে—'ঞ্চে?' সে
নির্বাক। কারণ রজা খোলার আগেই অনেকে বলে— এখন হবে
না গো, হাত গলি নেই। অন্য জায়গায় দেখ। দরজা খুলে অন্ধ
লোককে চোখের সামনে দেখলে মশা হতে বাধা। আর অন্য কেউ
হলে যা নিত তার চেয়ে বেশীই তাকে দেয়। যাকে বলে করুণার-
ব্যাপার স্যাপার।
একদিন হ'ল কি, সে এক বাড়ির দরজায় গিয়ে হাঁক দিল কই
গে', কেউ আছো নাকি?
পরমুহূর্তেই ওপরতলা থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল—কে? কে
আমার ভাইয়া বাক্বক মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে রইল।
ডাকটু হাসে একজন কাশতে কাশতে সরস্তা খুলতে এস—'কে?
দরজায় কে? কথা বলছে না কেন? কে গো?' দরজা খুলে দিল।
নরওয়াজা খোলার শব্দ শুনে বাকৃনক কাতর স্বরে বা
‘আমি অন্ধ মাগিক। এক মুঠো ভিক্ষা দিয়ে জানটা বাঁচান।
বাড়ির লোকটি বিচিত্র এক কাণ্ড করল। তার হাত ধরে বাড়ির
ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোজা তিন তলার ছাদের ওপর ভুগ। অঙ্ক
বাকৃত ভাবল, লোকটি খুবই দয়ালু। সামান্য কিছু ভিক্ষা না দিয়ে
পেট পুরে খাইয়ে দেবে।
কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের ভুল বুঝতে পারঙ্গ। লোকটি রীতিমত
ধমকাতে লাগল— 'আমি চিৎকার করে গলা ফাটলাম কে? কে
ওখানে? তখন সাড়া দিলে না কেন? আমাকে মিছে তিন তলা থেকে
নিচে নামালে কেন? হারাম কাঁধিকার তোমাকে আমি তিন তলা
থেকে থাকে নিচে ফেলে দেব।' পরমুহূর্তে বল – ঠিক আছে,
আল ছেড়ে দিলাম। তুলেও আর কোনদিন এরকম করবে না,
খেয়াল থাকে যেন। যাও পালাও।
বকবক সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পঠি হড়কে পড়ে গেল।
পড়িয়ে একেবারে নীচে চলে এল। চোট পেয়েছে। কয়েক গুণ
হড়েও গেছে। অন্ত্রণ।
যন্ত্রণাকাতর শ্মীরে পথে নামল দু'জন অঙ্গ সঙ্গী ছুটে গেল।
তার৷ জিজ্ঞসা করল— 'কি গে. সদার গোচ্ছে, মনে হচ্ছে। কি
ব্যাপার, কেউ মারধোর করল নাকি?
তার কথার উত্তরে বাবক নিজের নসীরের কথা বল্ল। তারা
তাকে সেদিনের মত ঘরে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিল। তাদের
একজন তাকে সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে রাজি
হয়।
তারা যখন এরকম পরিকল্পনা করছে ঠিক তখনই এক চোর
সেখানে হাফির হ’ল। সে অন্ধদের পিছু নিল।
অর্থ-বন্ধুটি বাৎকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য ঘরে
করে চোরটিও বিড়াঙ্গের মত পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে
গেল। ঘরের পাটাতন থেকে একটি শিকে ঝুলছে, দেখে চোরটি
সেটি ধরে পাটাতনের ওপরে উঠে গেল।
বাক ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখা টাকার খলি বের করে তা
থেকে এক দিরহাম অন্ধ বন্ধুটিকে দিল রুটি- তরকঃ কিনে আনার
জন্য। বাকি দিরহাম গুণে দেখল খুলিতে দশ হাজার দিরহাম
রয়েছে। এগুলো তার শরাজীবনে ভিক্ষা করে সঞ্চিত অর্থ।
ব্যক-এব অন্ধ বন্ধুটি রুটি-তরকা নিয়ে এসে ভাগ করে
খেতে লাগল। এমন সময় চোরটি পাটাতনের ওপর থেকে সন্তর্পণে
নেমে এল। তাদের পাশে বসে রুটিতে ভাগ বসাল। অন্ধ দু'জন তার
কারসাজির কথা জানতেও পারল না!
আমার ভাইয়া বাকক-এর কান খুবই পরিষ্কার সে চোয়াল
| নাড়ার শব্দ শুনে বুঝাতে পারহৃ তৃতীয় হৃদমি সংগোপনে ত্রুটি-
হরকা খেয়ে চলেছে। সে আচমা চিৎকার করে উঠল—'চোর
—চোৱ—-চোর!' তার সঙ্গে তার অন্ধ-বন্ধুটি পলা মিলিয়ে চিৎকার
জুড়ে নিল।
চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে প্রতিবেশীরা লাঠিসোটা নিয়ে ছুটে
গ্র
বাক চিৎকার করতে করতে তার হাত দুটোকে এদিক-ওদিক
চালাতে লাগল। চোরের হাতের সঙ্গে তার হাতটি ঠেকে যাওয়া মাত্র
সে হপ্ করে ধরে ফেলে। এবার নিজের পথচলার লাঠি দিনে তাকে
দমাদম পিটতে লাগল।
J
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে প্রতিবেশীদের আসতে দেখে চোরটি
চোখ বন্ধ করে বসে পড়ল। তাদের বল, আমরা সবাই অঙ্গ। এক
সঙ্গে ভিক্ষা করি! এতদিন ভিক্ষা করে আমার ভাগের দশ হাজার
দিরহাম ওয়েছে। আমার প্রাপ্য অস্ত বুঝে নিতে এসেছি। এবং
আমাকে দিরহামগুলি তো দিই না, উপরক্ত চোর চোর বলে
চেঁচিয়ে পাড়ার লোক জমা করছে। দোস্ত, তেহব' যখন চলেই
এসেছ তখন আমাকে কোতোয়ালের কাছে নিয়ে ১৮%। সেখানেই
আমাদের বিচার হবে। চোরের কথা শুনে আমার ভাইয়া বাঞ্চবক-
এর তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম।
তারা সবাই কোতোয়াগের শরণাপন্ন হই। রিহাম-এর বলিটি
তাঁর হাতে তুলে দিয়ে ন্যায্য বিচার প্রার্থনা করল।
চোর কোতোয়ালের সামনে নিজের বক্তব্য পেশ করেন। সে
সঙ্গে দাবী করল তার প্রাপ্য দশ হাজার দিরহাম।
বাত্বক প্রতিবাদ করল। সে বল্ল—‘হুজুর। লোকটি চোর।
আমাদের সঙ্গে তার কোনদিন সম্পর্ক ছিল না, আজও নেই ৷
দিরহাম-এর ভাগ সে কি করে প্রত্যাশা করে? কোতোয়াল পড়লেন
মহাসমস্যায়। কি ভাবে ঘটনাটির নিষ্পত্তি করবেন পথ খুঁজে পাচ্ছেন
না।
কোতোয়ালের সমস্যার সমাধান করে দিতে গিয়ে চোরটি বল
---‘হুজুর, আচ্ছা করে ঘা কতক দিন তবেই দেখবেন বাছাধনরা সত্যি
কথা বলতে পথ পাবে না।'
পরামর্শটি কোতোয়ালের খুবই মনে ধরল।
কোতোয়ালের নির্দেশে এক সিপাহী চাবুক হাতে পিটুনি শুরু
করার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়াল।
চোরটি বল্ল –‘হুজুর, আমাকে দিয়েই চাবুকের ব্যবহার শুরু
করুন।’ বার কয়েক চাবুকের ঘা-খেয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে
হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে ফেল। আসলে সে ভুলেই গিয়েছিল
যে, সে অন্ধের অভিনয় করছে।
ব্যাপার দেখে কোতোয়াল তো বিস্ময়ে হতবাক্ । চোরটি এবার
বল—‘হুজুর, আমারা কেউ অন্ধ নই। ভিক্ষে করার জন্য আমরা
এটিকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করি। বাকী তিনজনও আমারই মত।
আমার কথা বিশ্বাস করার দরকার নেই। চাবুক চালালেই সব কিছু
ফয়সালা হয়ে যাবে। খালি পয়সা রোজগারই নয় ফাউ হিসেবেও
এতে কিছু পাওয়া যায়।
—–‘ফাউ? সে কী হে, এতে আবার ফাউয়ের ব্যাপার কি থাকতে
পারে, বুঝিয়ে বল তো?’
–'অন্ধরা বাড়ির ভেতরে চলে গেলেও কেউ কিছু মনে করে
না। এদের দ্বারা বাড়ির জনানাদের আব্রু নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কম
থাকে। অন্দরমহলে ঢুকে আমরা চোখ খুলে দিলে মেয়েরা খুবই
অবাক হয়। সারা জীবন যারা পর পুরুষের মুখ দেখতে পায় নি তারা
সলাভে খুশী হয়। আর সুখ ছাড়া ভিক্ষার মাত্রাও যায় বেড়ে '
এবার কোতোয়ালের হুকুমে বাকুবক আর তার সঙ্গীর পিঠে
সম্পাং সপাং করে চাবুক পড়তে লাগল। কিন্তু কিছুতেই চোখ মেলে
না তারা। কোতোয়াল ভাবলেন —– হারামজাদারা বাস্তু ঘুঘু, পয়লা
নম্বরের শয়তান! বললেন—'জোরসে চাবুক চালাও।' এবার তারা
সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তবু চাবুক চালানো অব্যাহত
রইল। এবার সিপাহীরা তাদের চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে শহরের
বাইরে ফেলে দিয়ে এল।
কোতোয়াল এবার থলে থেকে তিন হাজার দিরহাম দিয়ে
বলেন—‘পালাও এখান থেকে। বাকি দিরহাম তাদের দু'জনের
জন্য রইস্ল। চোর হাতে স্বর্গ গেল। খুশি হয়ে নাচতে নাচতে বিদায়
নিল। কোতোয়াহু বাকি দিরহাম নিজের জেবে পুরলেন।
আমি ভাইয়া বাকুক-এর দুরবস্থার কথা জানতে পেরে তাকে
খুঁজে বের করি। নিজের কাছে নিয়ে আসি। সেবাযত্নের মধ্য দিয়ে
তাকে সুস্থ করে তুলি। এখন আমিই তার খানা-কাপড় দেই। ভিক্ষে
করতে দিই না। জাঁহাপনা, আপনি হয়ত এবার আমার মহত্বের কথা
তার অস্বীকার করতে পারবেন না।
বলিফ! খুশী হয়ে এক শ’ দিনার পুরস্কার দিয়ে আমাকে বিদায়
দিতে চাইলেন।
আমি সবিনয় নিবেদন রাখলাম— 'জাঁহাপন৷, এখনও তো
আমার তিন ভাইয়ার জীবনকাহিনী শোনার বাকি আছে। শুনবেন
না?'
খলিফা অল--মুসতানসির মুচকি হেসে বল্লেন—'বল। তোমার
বাকি ভাইয়াদের কিস্সা, আমি শুনব।'
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
জয় গুরু
বিশুদ্ধ প্রচারের স্বার্থে -
আপনার যে কোন মন্ত্যব, অভিযোগ, অনুরোধ আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান। ...