খলিফা অল-মুসতানসিরের সম্মতি পেয়ে আমি আমার চতুর্থ
ভাইয়া অল-কুজ-এর কিস্সা শুরু করতে গিয়ে বল্লাম—
‘জাঁহাপনা, আমার এ-ভাইয়ার পুরো নাম খুশবান অল-কুজ। তার
নামের অর্থ হ’ল কোন কিছু দিয়ে কাঁসার কুঁজো ঠুকলে যে আওয়াজ
উত্থিত হয়, ঠিক তা। সে ছিল এক কষাই। বাগদাদে ছিল তার বেশ
বড়সড় কারবার। তার দোকানের মত ভাল গোস্ত তামাম বাগদাদ
নগর ছুঁড়ে এলেও কোথাও মিলত না। তাই সহজেই সে দিনারের
পাহাড় বানিয়ে ফেল্ল। কিন্তু জাঁহাপনা, বিত্ত-সম্পদ তো সবার
নসীবে চিরদিন টেকে না।
এক সকালে পাকা দাড় গোঁফওয়ালা এক বুড়ো অল-কৃষ্ণ-এর
দোকান থেকে কিছু গোঙ খরিদ করল! ঝকঝকে চকচকে রূপোর
দিনারে দাম মিটিয়ে বিদায় নিল। তার সে দিনারগুলোকে সে অন্য
একটি গঞ্চির মধ্যে আলাদা করে রেখে দিন।
এবার থেকে বুড়োটি রোজাই কিছু করে গোস্ত কিনে আর
চক্চকে রুপোর দিনারে দাম মিটায়। আল বুরু সেগুলোকে আলাদা
এলেটিতে জমা করতে থাকে। ভাবল, তারও কিছু টিনার কমাতে
পারলে এক জোড়া ১৬৭ ভেড়া খরিদ করবে। ভেড়ার লড়াই
দেখিয়ে সবহিকে তাক লাগিয়ে দেবে।
এত সকালে দোকানে মোদেরের সপ একটু সামলে সে বুড়োর
দেওয়া দিনারের থলেটা হুল্ল। ভাবল, গুণে দেখবে, কত জমল।
থলে হাতে নিতেই তার চক্ষু চড়কগাছ। হলে ফাঁকা। দিনারের
নামগন্ধও নেই। সে আপন মনে বলে উঠল—'হ'য় আল্লাহ! এ কী
ভূহুড়ে কাগু। অন্য কারবারীদের কাছে কপাল চাপড়ে তাজ্জব
কান্ডটির*কথা বল। কেউ-ই তার কথা বিশ্বাস করল না। আষাঢ়ে
হলে হেসে উড়িয়ে দিল।
তারপর দিন বুড়ো যথারীতি গোল্ড খরিদ করতে এল। ব্যস,
আর যাবে কোথায় অল-কুজ এক লাফে গদি থেকে নেমে বুড়োকে
পিঠ মোড়া করে বেঁধে ফেল। এবার তার দাড়ি-গোঁফ কামাতে
লেগে গেল। সে সঙ্গে লাখি-বিল-চড় তো ফাউ। বুড়ো গরুচোরের
মত মুক্তে সব সহা করল
বুড়ো কোনরকম চিৎকার চেঁচামেচি না করে কেবর অনুচ্চকণ্ঠে
বলতে লাগল—আরে করছ কি! আমাকে ছেড়ে দাও!'
অল-কুম তাকে উত্তম মঞ্চম দেয় আর বলে— এখনই হয়েছে
কি মেরে তোমার মেরুদণ্ড গুঁড়ো করে ছাড়ব যাদুকর।'
বুড়ো বলে— 'কী সব ফুটমুট কথা বলছ! তুমি আমাকে ভেড়ার
গোল্ডের নাম কবে দিনের পর দিন মানুষের গোঙ দিয়ে ঠকিয়েছে।
অব এখন উল্টে আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছ, আমি বালুকায়,
মুয়াজ্জোর, ঠগ্।'
সেখানে মঙ্গা দেখার জন্য যারা জড়ো হয়েছিল সবাই তো
তাদের চসা শুনে অবাক। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে
পাগল— সে কী কথা! এতকাল আমাদের মানুষের গোস্ত
খাইয়েছে!”
বুড়ো রীতিমত জোর গলায়ই বলে উঠল—“হ্যা—হ্যাঁ, মানুষের
শোভ। ভেড়ার গোস্তের নাম করে মানুষের গেন্ত বিক্রি করে
প্রভারণ করে যাদেরদের সঙ্গে।'
অল-কুক্ত হতে চিৎকার করে বলে, ঝুট বাৎ। বুড়ো তার চেয়ে
জোরে গলা চড়িয়ে বলে— 'না, ঝুড়ি নয়, আমার বাং-ই মাচ।
মানুষের মাংসই শয়তানটা বিক্রি করে।'
বুড়ো সবাইকে নিয়ে অবহিয়ের যত্নে গেল যেখানে ভেড়া জবাই
করে গোস্ত টুকরো টুকরো করে বুলিয়ে রেখেছে। বুড়ো ঘরের
কোণের দিকে তধ্বনি নির্দেশ করে বলল—'আপনারা কি বলতে চল
ওগুলো ভেড়ার মুণ্ডু? আমি তো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি এগুলে|
মানুষের মুণ্ডু।
সবই মুহূ তিনটির দিকে তাকিয়ে আঁথকে উঠে বলল – হায়
আল্লা! একী দেখছি! এ কী পৈশচিক কাণ্ড!
ব্যস, আর দেরী নায় উপস্থিত সবাই বলরুদের স্তূপের মত এক
সঙ্গে জ্বালে উঠল। সঁপিয়ে পড়ল অলকুজ-এর ওপরে কিল-চড়-
লাথি সমানে চালাতে লাগল। আমার নিরপরাধ ভাইয়া যতই চিৎকার
করে বলে --বুড়োর কথা তোমরা বিভাস কোরো না। ও খাদুকর।
বাসুবলৈ ভেড়ার মুণ্ডুকে মনুষের মুণ্ডু বানিয়েছে। কিন্তু কে, কর
বাৎ শোক্ত। বরং কিন্তু চাড়ের সংখ্যা আরও বেড়ে গেল।
সবাই মিলে তামার ভাইয়াকে পিটিয়ে আধ-মর। করে টেনে
হিঁচড়ে নিয়ে গেল।কাতোয়ালের কাছে। সব কিছু শুনে কোতোয়ল
ডাকে তিন শ' না বের করদ করলেন। তারপর ঘাড় ধরে মূলুক
থেকে তাড়িয়ে দিল। তার স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু সম্পত্তি ছিল সবই
বাজেয়াপ্ত করস। সবই নসীবের ফেল। বাজারে লোকগুলো যখন
তাকে মারধোর করছিল তখন তার বাঁ চোট কাল হয়ে যায়।
সে অননো পায় হয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নিজের
হুলুক ছেড়ে অন্য মুলুকে চলে গেল।
ভিন দেশে গিয়ে সে ভাবার এক মোড়ের মাথায় জুতো সেলাই
করতে বলে যায়।
একদিন সে আপন মনে জুতো মেরামত করছে, এমন সময়
একদল সিপাহী চিৎকার করতে করতে এগোতে লাগাল—সব হট
হাও। রাস্তা আলি কর। হট যায়।'
এল-শৃক্ত ব্যস্ত হয়ে তার জুতো মেরামত করার সরঞ্জাম রাতে
না সরাতে ঘোড়ায় চেপে দেশের সুলতান সে-পথে এলেন
জল চোখে টুপি পরা অল-কুমকে দেখেই সুলতান ঘোড়া দাঁড়
করালেন। চিৎকার করে উঠলেন— সব রুখ যাও!'
কানা লোক অষা।। এমন অশুভ সক্ষণ দেখে তাঁর অর
শিকারে যাওয়া হউ মা।
সুলতান গর্জে উঠবেন-- 'অপয়া লোকটি আমার যাত্রায় বাধা
নিয়েছে। উচিত শিক্ষা দাও একে।
সুলতানের আদেশ পাওয়া মাত্র তার দেহরক্ষীর৷ অল-ক্রুজ এর
ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হোক মারধোর করে গলা খাকা দিয়ে
পথের ধারে ফেলে দিল।
স্থলভান শিকারে যাওয়ার পরিকটনা বাতিল করে রাগে গগস্
করতে করতে প্রাসাদে ফিরে গেলেন।
I
=
অল-কুজ ভাবল কোতল করার আদেশই যদি সুলতান দিয়ে
থাকেন তবে সিপাহীরা তাকে রেহাই দিল কেন? নিজেই এর উত্তর
বের করে ফেল্ল। মারধোর খেয়ে সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে
সিপাহীরা নির্ঘাৎ ভেবেছিল সে মরেই গেছে। মড়াকে আর তো
ফাঁসি দেওয়া বা শূলে চড়ানো যায় না। তাই তার জানটি টিকে গেল।
অল-কুজ এবার এমন এক মুলুকে হাজির হ’ল যেখানে কোন
■ সুলতানের অস্তিত্ব নেই।
।
ক’ দিন নিরাপদেই কাটল। এক বিকালে অল-কুজ পাহাড়ের
গা দিয়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দূর থেকে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনে
সচকিত হয়ে পড়ল। ভাবল, সৈন্য আসছে। ভয়ে তার কলিজা
শুকিয়ে গেল। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। পথের ধারে ভাঙাচোরা
একটা বাড়ি দেখতে পেল। পোড়ো বাড়ি। আর কথা নেই সোজা
বাড়িটির ভেতর ঢুকে গেল। হ্যাঁ, তার ধারণা অভ্রান্তই বটে।
বাড়িটিতে কেউ-ই থাকে না। সে একটি থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে
ব্যাপারটি লক্ষ্য করতে থাকে। এমন সময় ঘটে গেল একেবারেই
অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড । অতির্কিতে দু'জন গাট্টাগোট্টা লোক পিছন দিক
থেকে খপ্ করে তার ঘাড় ধরে ফেল্ল। তারা সমস্বরে গর্জে উঠল
–‘হতচ্ছাড়া শয়তান কোথাকার! তিন-তিনটে দিন আমরা তোমার
।
অল-কুজ যন্ত্রণাকাতর দেহে কোনরকমে তার ডেরায় ফিরে
এল। সে তার অপরাধ কিছু ভেবে পেল না। একজনকে জিজ্ঞেস
করে জানতে পারল সুলতান কানা লোককে একদম বরদাস্ত করতে
পারে না। তাই সিপাহীদের ঢালাও হুকুম দেওয়া আছে, এক চোখ
খুইয়েছে এরকম কোন লোককে দেখামাত্র কোতল করবে।
খোঁজে হন্যে হয়ে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছি। আর তুমি আমাদের
নিয়ে লুকোচুরি খেলছ!' কথা বলতে বলতে তারা তাকে বেধড়ক
পিটাতে শুরু করল। প্রায় আধমরা করে তাকে নিয়ে গেল
কোতোয়ালের দরবারে।
অল-কুজ্ঞ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তার নসীবের কথা,
কোতোয়ালের কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করল। তিনি তার কথা বিশ্বাস
করলেন না। তাঁর কাছে মিথ্যা কথা বলেছে ভেবে সিপাহীদের হুকুম
দিলেন 'উলঙ্গ করে চাবুক মারো মিথ্যাবাদী কানাটিকে!’
তার জোব্বা আর পাতলুন খুলতেই সিপাহীদের চোখের সামনে
ভেসে উঠল, সারা গায়ে চাবুকের কালসিটেপড়া দাগ।
কোতোয়াল সবিস্ময়ে বলেন –‘এসব কি হে! চুরি করে
উপহার পেয়েছ বুঝি? কোথায়? কোথায় ধরা পড়েছিলে, সত্যি
করে বল!
অল-কুজ কেঁদেকেটে বল –‘হুজুর, চুরি আমি কোনোদিনই
করিনি। তবে চাবুক খেয়েছি বহুবার। কেন এবং কার কার কাছ
থেকে এসব উপহার পেয়েছি সবই আমার বক্তব্যে উল্লেখ করেছি
আপনি হয়ত খেয়াল করেন নি।
– চুপ কর হারামজাদা মিথ্যাবাদী কাঁহিকার। সারা গায়ে
চাবুকের দাগ জ্বল জ্বল করছে! আর বলে কিনা চুরি করে নি। মিথ্যা
কথা বলার আর জায়গা পাও নি চালাও চাবুক। চাবুকের ঘায়ে খুন
বের করে তবে ছাড়ান দেবে।'
সিপাহী এবার শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে গুণে গুণে এক শ’ ঘা
চাবুক মারল। কেটে খুন ঝরল কয়েক জায়গায়। এবার উটের
| পিছনে আচ্ছা করে বেঁধে নগরের পথে পথে ঘোরানো হ'ল।
আমার ভাইয়া অল-কুজ শয্যা নিল। তার দুর্গতির কথা শুনে
আমি ছুটে গেলাম। এক রাত্রে চুপিচুপি তাকে বাগদাদ নগরে নিয়ে
• এলাম। ছেকিম ডেকে দেখালাম। তিনি দাওয়াই দিলেন। দীর্ঘদিন
ইলাজের পর সে মোটামুটি সুস্থ হ'ল। তবে সে প্রায় অকেজো হয়ে
পড়েছে। একই আম্মার পেটে ক্রুন্ম। তাকে তো আর আমার মত
উদার, সদাশয় ও পরদুঃখকাতর আদমির পক্ষে ফেলে দেওয়া সম্ভব
নয়। তাই তার যাবতীয় দায় দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিলাম।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
জয় গুরু
বিশুদ্ধ প্রচারের স্বার্থে -
আপনার যে কোন মন্ত্যব, অভিযোগ, অনুরোধ আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান। ...