খলিফা অল-মুসত্তানসির বিল্লাহ যখন আমার বড় ভাইয়ার
বোকামির কথা শুনে হেসে মাটিতে গড়াগড়ি যাবার উপক্রম হলেন
তখন আমি হাত কচলে নিবেদন করলাম— জাঁহাপনা, আমার
দ্বিতীয় ভাইয়া ভল-হাদ্দার-এর কিস্সা শুনলে তো আপনি বোধ হয়
মূৰ্চ্ছাই যাবেন। তার কাওকারখানার কথা সংক্ষেপে বলছি
শুনুন— তার অল-হাদার নামকরণের কারণ হচ্ছে, সে উটের গলার
মত নিজের গলাটিকে একবার সামনের দিকে লম্বা করে বাড়িয়ে
দিত আবার পরক্ষণেই টেনে পিছনের দিকে নিয়ে যেত। তার
ভঙ্গিটি বাস্তবিকই ছিল খুবই বিচিত্র। সব মিলিয়ে তার চেহারা ছবি
ছিল একেবারেই কদর্য। অকারণে সে লেড়কিদের সঙ্গে নিজেকে
জড়িয়ে ফেলে কত যে বিশ্রী কাও বাধিয়ে বসভ তার ইয়ত্তা নেই।
একদিন পথে এক বুড়ি তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বল্ল—'বাছ',
তোমাকে একটি বাৎ বলার জন্য ক'দিন ধরেই কলিজা উথালি
পাথালি করছে। তবে আমার কথা রাখবে কিনা তা তোমার মর্জি।
মুচকি হেসে হাদ্দার বল্ল-—'ঠিক আছে, বলই না শুনি কি বাং
বলতে চাইছ? সব শুনে বলব, তোমার কথা রাখতে পারব কিনা।'
—'বাছা, তবে একটি শর্ত আছে। আমার বাৎ শুনে আনাড়ীর
মত কোন বাং বলবে না বা কোন প্রশ্ন করে বসবে না। শোন,
তোমাকে আমি চমৎকার একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পারি আমি
নির্দ্বিধায় বলতে পারি একবার সেখানে গেলে তোমার দিল্ আর
সেখান থেকে আসতে চাইবে না। পাহাড়ী নদী কুলকুল করে বয়ে
চলেছে। ডাবের পানির মত স্বচ্ছ তার পানি। চারদিকে ফুল আর
ফলের বাহার—বিচিত্র সমারোহ। সরাব বেরিয়ে আসছে ঝর্ণা দিয়ে।
আর বেহেস্তের পরীর মত খুবসুরং যুবতীদের মেলা। দেখামাত্র


তারা তোমাকে ঘিরে ধরবে। তোমাকে চুম্বন করবে, জড়িয়ে ধরবে
আর সোহাগে সোহাগে তোমার দিল্ ভরিয়ে তুলবে। ধরা পরীদের
দেশে ক্রেমাকে আমি নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু বাহা, একটি শর্ত
তোমাকে পালন করতেই হবে।
– দুনিয়ায় এত আদমি থাকতে তুমি আমাকেই বা বাদাল
– বেটা, আগেই তো শফাই গেয়ে রেখেছি অফারণে প্রশ্নের
অন্তারণ! করবে না। কৌতূহল জাগলে তাকে জোর করে দমন
কর। কোন প্রশ্ন নয়।'
আর কোন কথা না বলে বুড়ি হদ্দারকে নিয়ে গেল সুরমা এক
অট্টালিকায়। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেই হাসান থমকে দাঁড়িয়ে
পড়ল। দেখল, চারটি খুবসুরৎ যুবর্তী বিভোর হয়ে গান গাইছে।
নবাগত হাদার কৈ দেপে চারজনের মধ্যে যার সুরৎ সবচেয়ে
বেশী সে উঠে এসে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তাকে
সাদর সম্ভাগ জানাল। গলিত পেত্রে বসতে দিল। দরান এনে প্লি
হান্দার পান করল। আর এক পেয়ালা নিয়ে এসে দিল হাদার
সরাবের পেয়ালাটি ঠোঁটের কাছে নিতেই লেড়কিটি তার গালে
আচমকা এক চড় বসিয়ে দিল।
হাদার রেগেমেগে চলে আসার উদ্যোগ নেয়। বুড়ি চোখের
ভাষায় তাকে উঠতে বারণ করে।
যুদ্ধার শরুদ্ধ করেছিল, তাই বাধা হয়ে বসে পড়ল। হূর্তীটি
আবার তাকে বার বার কিচড়-থাপ্পড় মারতে লাগল
হদার মুখ বুজে সব বরবাক্ত করল। টু-শস্পটিও করল না।
কারণ, সে যে বুড়ির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এবার যুবতীটি আরম্ভ হয় হাপ এগিয়ে গেল। হন্দার-এর
কোর্তা পাতলুন সব খুলে ফেল। এবার সে একেবারে উপস্থ
এবার আর একটি ঘুবর্তী উঠে এলে তার দড়ি ধরে মৃত্যু, এক
টান দিয়ে ধর্ – মেহবুশ, আমি দড়ির কেঁচা সহ্য করতে পারি
না! দাড়ি কামিয়ে এসো। পাশের ঘরে সব ব্যবস্থা রয়েছে
হাদ্দার বুড়িটির সঙ্গে পাশের ঘরে গিয়ে দাড়ি-গোঁফ এমন কি
দূর পর্যন্ত কামিয়ে এল!
যুবতীদের একজন তার সর্বাঙ্গে লাল অব সাদা রঙ দিয়ে ডোরা
কেটে দিল। মুখও বাদ দিল না। এবার তার দিকে তাকিয়ে হুবর্তীর
সবাই সমস্বরে হো হো করে হেসে উঠল
প্রথম যুবর্তীটি অবেগ মধুর স্বরে বল্স —'তোমার রূপে আমি
মুগ্ধ একটু নাচো তো দেখি কেমন পরো।'
হাদ্দার বুঝতে পরল--তার সঙ্গে বনিকতা করছে। মুখ বক্তার
করে সে পিছন ফিরে দাঁড়াল। খুবর্তীটি তার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে
এহর বলল – ‘মেংকুৰ আমর, বিশ্বাস কর, তামাশ্ম করছি না।



104
তোমার রূপ-যৌবন আমার দিকে রীতিমত নাড়া দিয়েছে। বিশ্বাস
রাখ, আমি মুগ্ধ। একটু নাচ মেহেবুব! তারপর আমরা মহব্বতের
খেলায় মাতব।'
হাদ্দার এবার উদ্দাম নৃত্য জুড়ে দিল। অনভ্যস্থ হাত-পা ছোড়ার
ফলে ফুলদানি, আতরদানি, সরাবের পেয়ালা সব দুমদাম পড়ে
গুঁড়িয়ে যেতে লাগল। যুবতীরা তো একে অন্যের গলা জড়িয়ে ধরে
হেসেই অস্থির।
এবার প্রথম যুবতীটি নিজের গায়ের পোশাক এক এক করে
খুলে ঘরের কোণে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল, আর হাদ্দার-এর
মধ্যে কামোম্মাদনা জাগিয়ে তোলার বিচিত্র সব অঙ্গভঙ্গি করতে
লাগল।
হাদ্দার-এর সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগল। শিরায় শিরায় খুনের গতি
বৃদ্ধি পেল। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। না, আর পারছে না সে।
খুনে তার মাতন লেগে গেছে।
বুড়ি বল্ল – 'বাছা, এখানকার প্রচলিত এক রীতির কথা
তোমাকে বলছি। লেড়কিটি ছুটে পালাতে চাইবে, তোমাকে ধরে
ফেলতে হবে তাকে। তোমার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকবে তাকে ধরে
ফেলা। যদি ধরতে পার তবেই সে তোমার শয্যা-সঙ্গিনী হবে।'
কিন্তু লেড়কিটি যখন এঘর-ওঘর দৌড়ে বেড়াতে লাগল তখন
বহু চেষ্টা করেও হাদ্দার তাকে ধরতে পারল না।
ভোরের পূর্বাভাস পেয়ে বেগম শাহরাজাদ কিস্সা বন্ধ
করলেন।
. একত্রিশতম রজনী
বাদশাহ শারিয়ার যথা সময়ে অন্দরমহলে বেগমের ঘরে


এলেন।
বেগম শাহরাজাদ কিস্সা শুরু করলেন—জাঁহাপনা, সে-দর্জি
চীনদেশের সুলতানের কাছে তার কিস্সা বলে চল--জাহ'পনা,
বাগদাদের সুলতানের কাছে নাপিতটি তার দ্বিতীয় ভাইয়া অঙ্গ-
হাদ্দার-এর বোকামির কথা বলতে লাগল। হাদ্দার তখন লেড়কিটির
পিছন পিছন হন্যে হয়ে ছুটোছুটি করতে লাগল। বৃথা চেষ্টা।
কিছুতেই সে তাকে ধরতে পারছে না। ছুটতে ছুটতে লেড়কিটি এক
সময় একটি ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। হাদ্দার ভাবে, এবার আর তাকে
আটকায় কে? লেড়কিটিকে অবশ্যই ধরে ফেলবে। কিন্তু নসীবের
ফের! ঘরের ভেতরটি ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাতটিকেও ভাল
করে দেখা যায় না, লেকিটিকে ধরবে কি করে? বাধ্য হয়ে সে
অন্ধের মত হাতাতে লাগল। অন্ধকারে কখন যে সে বারান্দায় এসে
পড়েছে, বুঝতেই পারে নি। তখনই ঘটল বিশ্রী ব্যাপারটি। বারান্দার
কার্নিশে পা পড়ামাত্র একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল নিচে রাস্তার
ওপরে। পাশেই একটি মুচি তাবুর তলায় বসে জুতো সেলাই করে।
মুচিটি দেখল, বিচিত্র এক লোক, দাড়ি-গোঁফ কামানো। এমন কি
ভুরু পর্যন্ত তার নেই। আর মুখ ভর্তি লাল-সাদা ডোরাকাটা।
আচমকা এসে পড়েছে তার সেকানের একেবারে সামনে। ভাবল,
কোন না কোন অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। মুচির দশাসই চেহারা। সে
আমার ভাইয়া হাদ্দারকে পিঠ মোড়া করে বেঁধে কোতোয়ালের
কাছে নিয়ে গেল।
কোতোয়ালের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মুচি এবার বল্ল-
‘হুজুর, শয়তানটি বোধ হয় চুপি চুপি উজির সাহেবের বাড়িতে ঢুকে
পড়েছিল।' ব্যস, বেশ করে উত্তম মধ্যম দেওয়া হ’ল তাকে।
একেবারে হাড়গোড় ভেঙে দেবার জোগাড় করল।
কোতোয়ালের নির্দেশে হাদ্দারকে নগর থেকে বের করে
দেওয়া হ'ল। আমি লোকমুখে তার দুরবস্থা ও বহুভাবে হেনস্থা
হওয়ার খবর পেয়ে ছুটে যাই। গোপনে তাকে আমার কাছে নিয়ে
আসি। লুকিয়ে রাখি যাতে কাক পক্ষীও টের না পায়। বরাত গুণে
আজ সে পঙ্গু। আমার ওপরে নিজের দায়িত্ব সঁপে দিয়ে কোনরকমে
দিন গুজরান করছে।
জাঁহাপনা, আমার দ্বিতীয় ভাইয়ার জীবনকথা তো শুনলেন
এবার আমার তৃতীয় ভাইয়ার কথা বলছি।