এবার কাফুর নামে এক নিগ্রোর পালা। সে তার খোজা হওয়ার
কিস্সা শুরু করতে গিয়ে বল্ল ——'আমার ওমর তখন আট সা
আমি তখন থেকেই পুরোপুরি লম্পট হয়ে উঠেছিলাম। মিথ্যা কথ৷
বলার স্বভাব তো ধরতে গেলে আমার খুনের সঙ্গেই মিশে
গিয়েছিল। আর সৎ কাজের ধার কাছ দিয়েও আমি যেতাম না। তা
ছাড়া যতরকম কু-বিদ্যা আছে সবই আমি সে সময় থেকেই রপ্ত
করে ফেলেছিলাম। তবে আমি মিথ্যা কথা বলতাম বটে। কিন্তু সব
সময় নয়। সারা বছরের মধ্যে বেছেবেছে মাত্র একবার মিথ্যা কথা
বলতাম। তবে হ্যাঁ তাতেই সারা বছরের শোধ তুলে নিতাম।
নোক্ষম সে চাল। যার জন্য আমার মালিকদের প্রভূত ক্ষতির বোঝা
বইতে হয়েছে। একবার এরকমই জব্বর এক মিন্ডা চাল চালতে
গিয়েই আমাকে খোজা হতে হয়।
যখনকার কথা বলছি তখন আমি এক বণিকের অধীনে দিন
শুমেগান করছিলাম। সে ক্রীতদাসের কারবার করে। আমার আগের
মালিকের কাছ থেকে সে সঞ্জ: দামে আমাকে খরিদ করে নিয়েছিল।
তারপর সে আকার বেচার জন্য নিয়ে ক্রীতদাস কেনা-বেচার হাটে
নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। নীলালে দর উঠলপুশ দিরহাম। আর
দারি কুড়ি নিরহাম। বেচার সময় বণিক বলেই দিয়েছিল কামকাজ
আমি খুবই ভাল পারি। কিন্তু দোষ একটিই। প্রতি বছরে একবার
করে মিথ্যা কথা বলি
আমার নয়া মালিক আমাকে মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত
রাখার জন্য পড়ানোর মত করে বুঝাতে লাগল এক দু'করে দুঃ
দু'টি মাস কেটে গেল। অনার মালিক ভাবা কি তার দাওরাইয়ে
সক্ত হয়েছে। ভুলেও আমি অর মিথ্যা কথা বলব না।
এক সন্ধ্যায় মালিক আমাকে এক মীর আদমির বাড়িতে
নিয়ে গেল। বাগিচার ঠিক মাঝখানে সুন্দর সে ছোট্ট বাড়িটি। তার
মুখে শুনলাম, সেখানে নাচা, গালা আর খানাপিনা হবে। তখন ইয়ার
দোওরা এক এক করে ক্রমায়েত হতে লগল।
মালিক আমাকে এক সময় বলেন- 'বড্ড ভুল হয়ে গেছে।
আসমানির ওপত্রেঃ দশ ডোডা তাশ ফেলে এসেছি। আমার খচ্চরটি
নিয়ে গিয়ে চটকরে নিয়ে আয়গে।'
আমি খচ্চরের পিঠে চেপে বাড়ি ফিরলাম। সদর দরজা থেকে
বিলাপ পেড়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকলাম। আমার কান্না শুনে
মালিকের যিনি আর তার পেড়লি ছুটে এল। আমি কান্না অব্যাহত
রেখেই বল্ল্লাম—'মালিক মারা গেছে। কাঁদতে কাঁদতে একর
বল্লাম—বাগিচার প্রাচীরের ওপরে উঠে একটি মুসম্বি লেবুর
গাছ থেকে লেবু পাড়তে গিয়ে পড়ে যায়। একেবারে ফেঁটেফুটে
ধপাস। বস খেল খতম এখন কি উপায় মালকিন?'
আমার কথা শুনে বাড়িতে কান্নার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে
গেল। কে, ৰার চেয়ে বেশী জোরে কেঁদে শোক প্রকাশ করতে
পারে তারই প্রতিযোগিতায় যেন সবাই মেতে গেল। তখন সবাই
প্রায় উন্মাদ দশা প্রাপ্ত হয়েছে। বাড়ির খাল' বাসন আসবাবপত্র সব
ভেঙেচুরে শোক প্রকাশ করতে পগল। লেপ, তোষক, চার ও
কাঁথা প্রভৃতিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হ'ল। সব মিলে এক বীভৎস
কাঞ্চ শুরু হয়ে গেল।
এবার শুরু হ’ল প্রচলিত গ্রুপ অনুযায়ী শেক প্রকাশ। চুল খুলে,
বোরখা ফেলে দিয়ে উন্মাদিনীর মত কাদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে
সবাই ছুটোছুটি দাপাদাপি শুরু করে দিল। প্রতিবেশীরা বেরিয়ে
এসে নানা ভাবে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করল। কেউ বা দেওয়ালে
আলকাতরা মাখিয়ে শোকের চিহ্নটিকে অধিকতর স্পষ্ট করার
কাজে লেগে গেল।
‘প্রতিবেশীরা বলাবলি করতে লাগল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে।
শতমন সবার আগে ঘটনাটিকে কোেতায়ালের নজরে আনা
প্রতিবেশীদের কয়েকজন আমার মালকিনকে নিয়ে
কোতোয়াদের বাড়ির দিকে হাঁটা ভুল।
জামি দেখলাম, এতক্ষণে সুযোগ পাওয়া গেছে। দশ কোড়া
হ্রাস নিয়ে আগর খচ্চরটির পিঠে চেপে বসলাম।
হেলাম শাহরাজাদ ভোরের পূর্বাভাষ পেরে কিস্সা বন্ধ
করলেন।
উনচল্লিশতম রজনী
বাদশাহ শারিয়ার প্রায় মধ্যরাত্রে অন্দরমহলে বেগমের কাছে
বেগম শাহরাঝাদ তাঁর কিস্সার পরবর্তী অংশ গুলে
করছেন— 'জাঁহাপনা, নিগ্রো খোজা কাফুর তার খোঁজা হওয়ার
| কিস্সা বলে চলেছে সে এবার বল—
আমি খচ্চরের পিঠে চেপে
বাগিচার সে-বাড়িতে বিশপ পেড়ে হাউমাউ করে কেঁদে মালিকের
সামনে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লাম। কেঁদেকেটে বল্লাম---‘হুজুর,
তুমি আর বলতে পারছি না! কে যেন আমার গা চেপে ধরছে।
স্বামি পারব না! মালিকের পায়ের কাছে পড়ে আমি বুক চাপড়ে
কঁদছি আর সমনে আস্থাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছি।
মালিকের পীড়াপীড়িতে আমি কান্ন'র বেগ কমিয়ে কোনরকমে
বলতে লাগলাম—আমি খচ্চরের পিঠে চেপে লড়ির কাছাকাছি
যেতেই দেখি বাড়ির সামনে হাজার হাজার আদমি জড়ো হয়েছে।
অস্থার তখন মাথায় ব্যক্তপড়ার উপক্রম হ'ল।
মালিকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটার উপক্রম হ’ল। তিনি ক্ষেপে গিয়ে
জমাকে প্রায় মেরেই বসেন। বলেন—'হারামজাদা, তখন থেকে
শুধু করেছে আর ধানাইপানাই করছে। এস্ত লোক কেন, কি হয়েছে
| আর তুই-ই বা এমন বিলাপ পেড়ে কদছিস কেন?'
—হুজুর, প্রথমে আমি লজ্জই করিনি যে, আমাদের বাড়িটি
একেবারে ধসে পড়েছে। বাড়ির ফোন আদমি তো দূরের কথা হাঁস,
মুরগি, বহুরি, গাই কিছুই কিন্দা নেই। সব খতম। দেয়ালচাপা পড়ে
| সবই মারা গেছে।
ব্যস, আর যাবে কোথায়। বেল শুরু হয়ে গেল। আমার মনিব
| শাঁদতে কাঁদতে চুল-দাড়ি টেনে টেনে ছিঁড়তে লাগলেন। ইয়ার-
ভোক্তরা তাকে নানাভাবে প্রবোধ দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ধরাধরি
করে তাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হ'ল।
কিছুদূর যেতে না যেতেই বিপরীত দিক থেকে কান্নার শব্দ
ভেসে আসতে লাগল। একটু পরেই দেখা গেল যেন শোক-মিছিল
এগিয়ে আসছে। মিছিলের সামনে আমার মালকিন। গায়ে বোরখা
নেই। মাথার চুল এলোমেলো। উন্মাদিনী যেন ধেয়ে আসছেন।
আমার মালিক তখন যেন হঠাৎ আশমান থেকে জমিনে
পড়েছেন। হতভম্ব।
মালকিন ছুটতে ছুটতে এসে মালিকের ওপর আছাড় খেয়ে
পড়ল। লেড়কা—লেড়কিরা এসে কাঁদতে কাঁদতে আব্বাকে
জড়িয়ে ধরে।
আমার মালিকের আর ব্যাপারটি বুঝতে বাকি রইল না। আমার
কারসাজিতেই যে এমন বিচ্ছিরি ব্যাপারটি ঘটেছে বুঝতে পেরে
আমার কোর্তা চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলেন
— হারামজাদা, হতচ্ছাড়া পাজি কাহাকার।' বলেই সজোরে
আমার চোয়ালে মোক্ষম একটি ঘুষি চালিয়ে দিলেন। ব্যস, আমার
ওপর সমানে কিল, চড় আর লাথির বৃষ্টি পড়তে লাগল।
আমি মালিকের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বল্লাম—'মালিক,
আমাকে কেন মিছে মারধোর করছেন। বণিকের কাছ থেকে
আমাকে যখন কিনেছিলেন তখন রসিদে তো আমার চরিত্রের এ-
বিশেষ গুণটির কথা উল্লেখ করাই ছিল। আমার সম্বন্ধে সবকিছু
জেনেশুনে তবেই তো আমাকে বাজার থেকে কিনে এনেছিলেন।
আর মিথ্যা রসিকতার কথা যদি বলেন তবে মনে করতে পারেন
এটা পুরোটা অবশ্যই নয়, আধখানা রসিকতামাত্র, আরও আধখানা
তো রয়েই গেছে।'
মিছিলের সঙ্গে কোতোয়ালও ছিলেন। তাঁর নির্দেশে আমার
পিঠে ঘন ঘন চাবুক পড়তে লাগল।
আমি মালিকের বাসন কোসন আসবাবপত্র আর লেপ-তোষক
প্রভৃতি নষ্ট করেছি এই অজুহাতে মালিক আমাকে খোজা করে
দিলেন। খোজার বাজারদর সাধারণ ক্রীতদাসের চেয়ে বেশী বলে
আমাকে আবার ক্রীতদাসের বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হ’ল। এভাবে
বার বার বিক্রি হতে হতে এক সময় এক খলিফা আমাকে কিনে
নিয়ে গিয়ে হারেমের কাজে লাগিয়ে দিল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
জয় গুরু
বিশুদ্ধ প্রচারের স্বার্থে -
আপনার যে কোন মন্ত্যব, অভিযোগ, অনুরোধ আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান। ...