খ্রীস্টানটি তার কিসসা শুরু করতে গিয়ে বলল—তাঁহাপনা,
আপনি দীন দুর্নয়ার মালিক। আমি এক বিদেশী, খ্রীষ্টান। আমার
জন্মভূমি কায়রো। বিভিন্ন দেশ ছুঁড়ে শেষ পর্যন্ত আপনার
সুলতানিয়তে এসে থিতু হলাম। শুরু করলাম কারবার। দালালীর
কারবার। আমার আব্বাঙ্গীও এ-কারবারই করতেন। বলতে পারেন
এটি আমাদের বংশগত কারবার। আব্বাজী বেহেস্তে গেলে আমিই
কারবারের সর্বেসর্বা হলাম।
এক সকালে গাধার পিঠে চেপে এক যুবক আমার কাছে এল।
সুদর্শন যুবক, তার চোখে-মুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে আগন্তুক যুবকটির দিকে তাকালাম।
সে কামিঙ্গেঞ্জ জেব থেকে এক মুঠো স্ফীরার বীজ বের করে আমার
সামনে ধরে বলে- 'এখন দর কত যাচ্ছে, বলুন তো?।'
—‘একশ দিরহাম।'
– ঠিক আছে, আপনি তবে খান-অপ-জয়ালী বিজয়
দরওয়াজের কাছে চলুন। আমি অপেক্ষা করব।'
ক্ষীরার বীজগুলি আমার সামনে রেখে সে বিদায় নিল। আমি
ক্ষীরার বীজগুলো নিয়ে এক মহাজনের কাছে গেলাম। সে এক'শ
দশ দিরহাম দর দিয়ে কিনতে রাজি হল, আমার দশ দিরহাদ করে
লাভ হবে।
আমি খ্রীস্টানটির কাছ থেকে পঞ্চাশ মন বীজ কিনে ফেললাম।
যুবকটি বলল, আপনি তবে প্রতিমনে দশ দিরহাম করে দালালি
পেয়ে যাচ্ছেন। মাল নিয়ে যান। আপনার দালালির পাঁচ শ' দিরহাম
কেটে থাকি সাড়ে চার হাজার আপনার কাছেই জমা রাখবেন।
আমি সুবিধামত সময়ে গিয়ে বাকি সেগুলো নিয়ে আসব।
সেদিন আমার মোট এক হাজার দিরহাম রোজগার। পাঁচশ'
পাই বীজের মালিক যুবকটির কাছ থেকে আর পাঁচশ' পাই
মহাজনের কাছ থেকে।
প্রায় এক মাস পরে যুবকটি এলে তার প্রাপ্য সাড়ে চার হাজার
দিরহাম তাকে দিতে চাইলাম। সে আরও কিছুদিন পরে নেবে
বলল। তার কাছে নাকি রাখার একটু অসুবিধা।
₹
প্রায় এক মাস পরে যুবকটি এল। আমি দিরহামগুলো নিতে
= বললে সে আরও কিছু দিন আমার কাহেই জমা রাখতে বল।
আরও মাস খানেক পরে একদিন আমার বাড়ির সামনে দিয়ে
যাচ্ছিল। আমাকে দেখেই চিৎকার করে বল্ল—'এখন আর নামব
না। জরুরী কাজে যাচ্ছি। সন্ধ্যার দিকে এ পথেই যাব। তখন
দিরহামগুলো নিয়ে যাব।'
আমি সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার পর থেকেই দিরহামগুলো
=
কিন্তু তার অপেক্ষায় বসে রইলাম। কিন্তু সে ফিরল না।
শুরু এক মাস পরে হঠাৎ একদিন সে উদয় হল। আমি
নিমের পলেটি এনে তার সামনে রাখলাম। এবারও সে নিল না।
হকরও বেশ কিছুদিন কেটে গেল। এক বিকেলে টাটুর পিঠে
ত্রুতে হুংকটি হাজির হল। চকমকে পোশাক পরিহিত। আমি =
উদ্রেগুলো এনে তাকে দিতে চাইলাম। বল্লাম— পরের গচ্ছিত
| ব-দৌলত যে কী দুশ্চিন্তার ব্যাপার ডা তৃষ্ণভোগী ছাড়া জানে
। এগুলো নিয়ে আমাকে চিন্তামুক্ত কর।'
—কিছু মনে করবেন না, আর কদিন দয়া করে ধৈর্য ধরুন।
পত্রিকার পার হয়ে তার অনুরোধ রক্ষা করতে সম্মত হলান।
দেন যুবকটিকে খানাপিনা করতে অনুরোধ জানালাম। রাক্তি
হস সাধ্যমত আয়োজন করলাম। সে পরিতৃপ্তিসহকারে স্বকিছু
কোন একটি ফিনিস দেখে অকস্মাৎ আমার নটি মোচড় দিয়ে
গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বাঁ-হাত দিয়ে খেলো। ভাবলাম
কেন=বে হয়ত তার ডান হাতটি জখম হয়ে গিয়েছিল।
কাপারটি আমার মনে আরও বেশী কৌতূহল সঞ্চার করল
জর্জ দেখলাম ডানহাতের সাহায্য না নিয়েই সে তার বাঁ-হাতটি
নিध
শুভে ফেলে।
আমি জিজ্ঞাস করলে সে স্নান হেসে গায়ের চাদরটি সরিয়ে
বে, তার ডানহাতটি কব্জির কাছ থেকে কাটা।
আজাত কৌতূহল নিবৃত্ত করতে গিয়ে যুবকটি বল – হুজুর,
আমি একবার কায়রো নগরে গিয়েছিলাম। এক সরাইখানায়
আমাকে থাকতে হয়েছিল। বিক্রি করার জন্য বিভিন্নরকম পোশাক
নিয়ে দিয়েছিলাম। উটের পিঠ থেকে নফর সমানপত্র নামাল।
কার আনার জন্য তাকে একটি নিনার দিয়েছিলাম। পথশ্রমে ক্লান্ত
দুসের শরীর বিছানার আশ্রয় পেতেই এলিয়ে পড়লাম। গভীর
= শুদ্ধ হাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সমানপত্র উটের পিঠে চাপিয়ে ব্যবসা
ধন্দায় নম্বরটিকে নিয়ে শহরের বাজারে গেলাম। ধরাত
। একের পর এক বহু মহাজনের দরজায় ঘুরেও একটি জামাই
কাপড়ও কাউকে গছাতে পারলাম না। আর যে দাম দিতে চাইল
ক
ghe
(6))
নে
ঘর অংসার ক্রসমূল্যের চেয়েও কম।
ম
ए
সবশেষে এক দালাল বল– চুকুর অন্যান্য ব্যবসায়ীরা ম
এইনে যা কিছু করে আপনাকেও তাই করতে হবে। সমনপত্র যা
আছে সব ধারে বেড়ে দিন। মাল দেয়ার সময় হুণ্ডি করিয়ে দেব
একমাস পর প্রতি সোম আর বৃহস্পতিবার দ্বারা কিস্তি দেয়। দু
শরহে মাত্র দু'দিন আসে পাওনাগণ বুঝে নিয়ে যাবার জন্য।
অষ্টংটি আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হ'ল। ব্যস, দালাল 어
ফং সবকিছু বিক্রি হয়ে গেল। নগদ অর্থকড়ি কিছুই পেলাম না।
ক্রেতারা ছত্তির কাগজ তৈরী করে দিল।
সন্ধ্যায় গ্রাম্য মেয়েদের নাচাগানা দেখে মেজাজ একটু চাঙা
করে সরাইখানায় ফিরলাম। একমাস ধরে বহুত মজা লুটলাম।
দালালটি খুবই কর্মতৎপর। ঘুরে ঘুরে বেশ কিস্তির টাকা আদায়
করে এনে দেয়।
একদিন এক রেশম কাপড়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। গল্পটজ
করে মেজাজ একুট শেরিফ করে নেওয়ার ইচ্ছা। দোকানি আমার
প্রায় সমবয়সী। খুবই মিশুকে ও আড্ডাবাজ। একথা-সেকথার
ফাঁকে সে আমাকে বল্ল, আমার চেহারাছবি নাকি লেড়কিদের খুব
পছন্দ। এরকম বহু কথা শুনে আমার কালিজাটি একেবারে
চনমনিয়ে উঠল।
p
এরই মধ্যে বোরখায় আপাদমস্তক ঢেকে এক জেনানা এসে
আমার সামনে বসল। কাপড় কিনতে আগ্রহী। তার গা থেকে
ভুরভুর করে দামী আতরের খুসবু বেরিয়ে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ছে।
বোরখার নাকাবটি এতই পাতলা যে তার মধ্য দিয়ে কাঁচা হলুদের
মত তার গায়ের রঙ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। ছুঁচলো নাক। হরিণীর
মত ডাগর ডাগর চোখ। কপালের ওপর দু-চারগাছ কোঁকড়ানো চুল
তার মুখের সৌন্দর্যকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। একটু আগেই
দোকানির কথা আমার কলিজায় আদি রসের সঞ্চার ঘটিয়েছে।
তার পর-মুহূর্তেই বেহেস্তের পরীটি মুখোমুখি এসে বসল। এক
লহমায় তার দিকে তাকাতেই আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে
পড়লাম। কলিজাটি উত্থালি পাথালি শুরু করে দিল। একটু পরেই
নিঃসন্দেহ হলাম, সে-ও আমার দিকে কম ঝুঁকে পড়েনি। বোরখার
নাকাবটি সামান্য সরিয়ে আচমকা আর্থি-বাণ আমার দিকে ছুঁড়ে
দিল। আমার কলিজাটি অকস্মাৎ সেন ডিগবাজী খেয়ে ধীরে ধীরে
আবার সোজা হয়।
এক সময় অভাবনীয় মিষ্টি মধুর স্বরে সে দোকানিকে বল,
——'সোনার জরির কাজকরা ভাল মসলিন দেখতে পারেন??
দোকনি একের পর এক শাড়ী তার সামনে রাখতে লাগল।
একটি হাতে তুলে নিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করা হয়। দাম গুলে
বল্ল—'কিন্তু আমার সঙ্গে তো এত দিনার নেই। আমি বরং এটি
নিয়ে যাচ্ছি। বাকি দিনার পরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।'
--কিছু মনে করবেন না। এতগুলো দিনার দাম, ধারে দেওয়া
যাবে না। মহাজন সামনেই বসে। দুঃখিত, দাম নিয়ে এসে পরেই
না হয়—'
—“হিঃ: এরকম আচরণ করছেন। এতদিন ধরে হাজার হাজার
দির লেনদেন হয়েছে। কোনদিন বাকি ফেলে রেখেছি, বলুন?'
শাড়ীটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এবার বল—'আসলে আপনারা শুধু
সমপত্র কেনাল্ডোই করেন। অসল নকল খদের চিনতে পারেন
না।' তার যৌবনভরা দেহপল্লবটিকে এক ঝটকায় টুল থেকে তুলে
নিয়ে ক্রোধমত্তা সিংহীর মত পটুমট্ করে চলে গেল।
ব্যাপারটি আমার কাছে মোটেই সৌানোর পরিচায়ক বলে
মনে হল না। মেয়েটি খুবই অপমানিত হয়েছে। লম্বা লম্বা পায়ে
এগিয়ে গিয়ে আমি তার পথ আগলে দাঁড়ালাম মুখ কাচুমাচু করে
বল্লাম--- 'দেখুন, যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। আপনি চলুন,
শাড়ীটি নিয়ে যান।
—'দেখুন, দোকানির আচরণ বাস্তবিকই শিষ্টতা বহির্ভূত।'
এবার নাকারের ফাঁক দিয়ে দু'চোখের বাশ ছুঁড়ে বন্ধুর
‘হেনামাত্র আপনার দিকে তাকিয়েই যেতে পারি।
আমি অপরিচিতা হরিণীটিকে দোকালে নিয়ে গিয়ে এগার শ
দিরহাম মুল্যের শাড়ীটি দোকানির কাছ থেকে নিয়ে হাতে তুলে
দিলাম। বিনিময়ে কোনিকে একটি রসিদ লিখে দিলাম।
এবার মুচকি হেসে মেয়েটিকে বল্লাম —প্রতি বৃহস্পতিবার
আমি এ তল্লাটে আসি। মন চাইলে শড়ীটির দাম দিতেও পরেন
নইলে আমার তরফের উপহার এ মনে করতে পারেন।'
মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত ক'টি মেলে ধরে অপূর্ব সুন্দর
ভঙ্গিমায় হেসে পেড়কিটি বল—'এত সুন্দর আপনার ব্যবহার
থে, পাপ্প বলার নয়। এমন মহানুভব মানুষ আজককে সচরাচর
চোখেই পড়ে না। থোদাতাল্লার দোয়ায় আপনার হয়ত অনেক ধন-
| দৌলত আছে। তবুও যে আমাকে একবার মাত্র দেখেই আমার
| চরিত্র সম্বন্ধে ধারণা করতে পেরেছেন সে আপনার অপরিমিত
অভিজ্ঞতার জন্যই হয়ত সম্ভব হয়েছে যদি মেহেরবানী করে
গরীবের কুটীরে একবারটি পায়ের ধূলো দেন তবে ধন্য হ'ব।'
আমার ভেতরে কামস্পৃহা ত চড়াক করে মাথা চাড়া দিয়ে
উঠল। সাহসে ভর করে বলেই ফেললাম—'সুন্দরী, আমাকে
বাড়িতে আমন্ত্রণই যখন জানাতে পারলেন তখন আর বিভেদের
প্রাচীরটুকু অক্ষুণ্ণ রেখে আমার কলিজাটিকে কেন মিছে পীড়া
দিচ্ছেন? ওড়নার নাকাবটি সরিয়ে ফেলে ওই কমলবদন দেখে |
মনপ্রাণ শান্ত করার সুযোগ দিলে জীবন সার্থক জ্ঞান করব।'
মেয়েটি নাকাব তুলে নিয়ে ঠোঁট টিপে টিপে হাসতে লাগল।
হঠাৎ চার চোখের মিলন ঘটে যাওয়ায় শরমে তার মুখাবয়বটি
সিঁদুরে মেঘের মত রক্তাভ হয়ে উঠল। আকস্মিক শরমে চোখ
নামিয়ে নিল কিন্তু আড়চোখে আমাকে দেখার লোভ সামলাতে
পারল না। ঠোঁটের কোণের দুষ্টুমিভরা হাসির রেখাটুকু মুহূর্তের
জন্যও মিলিয়ে যায়নি।
আমার বুকের মধ্যে 'কেমন যেন এক অনাস্বাদিত ধুকপুকানি
শুরু হয়ে গেল। হৃদস্পন্দন দ্রুততর হ’ল। রক্তের গতি বৃদ্ধি পেয়ে
গেল মুহূর্তের মধ্যে।
লেড়কিটি আবার মুখ খুলল- 'আমার ঠিকানা দোকানির
কাছেই পেয়ে যাবেন। আশা করি অবশ্যই আমার বাড়ি আসছেন,
কি বলেন?'
আমি কিছু বলার আগেই সে শাড়ীটি হাতে নিয়ে দোকান
ছেড়ে রাস্তায় নেমে গেল। আমি তার ফেলে যাওয়া পথের দিকে
তাকিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেল্লাম।
সারাটি দিন সে-অপরূপার ডাগর ডাগর চোখের মন পাগল
করা চাহনি, বিচিত্র ভঙ্গিতে ভ্রুনাচানো, ঠোঁটের কোণের
কামোদ্দীপক হাসি—আমার মনকে পীড়া দিতে লাগল।
সরাইখানায় পৌঁছে রাত্রে খানাপিনা করতে আর মন ঢাইল না।
শুয়ে পড়লাম। ঘুম এল না। মন-প্রাণ যদি সুস্থির না-ই থাকে তবে
ঘুম তো আসতে পারে না। মানবাধি পর্যন্ত নিদারুণ অস্থিরতার
মধ্যে বিছানায় পড়ে ছটফট করলাম। বাকি রাত্রিটুকু কাটালাম
অস্থিরভাবে পায়চারি করে।
কাকডাকা ভোরে গোসল সেরে ঝকমকে দামী পোশাক পরে
নিলাম হাঁসতে হাঁটতে বার-অল-দীন-তার দোকানে গেলাম।
আমার পোশাককে কেন্দ্র করে বদর রম-ভালায় মেতে উঠল।
আমার আকাঙ্ক্ষিতা সে অপরূপা গুটিগুটি পায়ে দোকানে
ঢুকল। সে কিন্তু ভুলেও দোকানির দিকে চোখ ফেরাপ না। সর্বক্ষণ
অযার মুখের দিকে দৃষ্টি বন্ধ রাখল। কুশল বার্তাদি আদান-প্রদান
হ'ল আমার মধ্যে! ভারপর উঠতে উঠতে বলল—'আপনার কান
লোক আছে, একবারটি আমার সঙ্গে বাড়ি যেত? আপনার প্রাপ:
মিনার ত্রুটি তার হাতে দিয়ে দিতাম।'
—'আপনি কেন সে শাড়ীটির জন্য এমন উতলা হচ্ছেন, বুঝছি
না! এত ৰাক্তৃতা ফিসের? পরে যা হয় দেখা যাবে। সামান্য ক'টা
ভিরের অজুহাতে হয়ত দেখবেন কোনদিন আপনার ঘরে গিয়ে
হয়েছি।'
ঠিক করে হেসে উঠল লেড়কিটি। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে
খরুল বিচিত্র ভঙ্গিতে। থলি খুলে এগারশ দিরহাম আমার হাতে
শুরু দিয়ে বল্ল- 'অহাতের দরকার হবে না। যখন দিল চায়
যাবেন। চলি।'
কোন থেকে বেরিয়ে দোঝা হাঁটা জুড়ল। একটি ব্যাপার
কিন্তু আমার কাছে সুস্পষ্ট হল: দিরহামগুলো আমার হাতে
সওয়ার সময় তার হাতের আঙুলগুলো প্রয়োজনের তুলনায় একটু
কোর্ট সময়ই আমার হাতের তালু স্পর্শ করেছিল। তার কি হ'ল।
বটুকু কি পেল আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে মুহূর্তের
স্পর্শেই আমার শরীরের শিরা উপশিরাগুলে ঝনঝনিয়ে উঠেছিল।
বুকের স্পন্দন দ্রুততর হয়ে পড়েছিল। কোন নারীর সামান্য স্পর্শে
| এত সুৰ-উৎপাদন করতে পারে তা আমার অন্ততঃ জানা ছিল না।
আরে বুঝতে বাকি রইল না বনময়ূরী ডালে হুটিকা পড়েছে।
আকুপন মনে হাসলাম।
আমিও দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। তার পিছু নিলাম। কিন্তু
অসাৎ সে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল। মনটি অস্বাভাবিক
নিষিয়ে উঠল। এমন সময় তেরো-চোদ্দ বছরের একটি মেয়ে
অহর সামনে এসে মুচন্টি হেসে বল্ল---মেহেরবানি করে আমার
অফিসের ঘরে একবারটি পায়ের ধুলো দেখেন? তিনি আপনার
সঙ্গে জরুরী কিছু কথা বলতে আগ্রহী।'
—বহুত আচ্ছা! চল, এখনই যাওয়া যাক।'
একটি দোকানের পাশে তাঁর সঙ্গে দেখা। চোখে ইশারা করে
জানালো পাশের এক নিরিবিলি জায়গায় আমাকে যেতে হবে।
আমি তার নির্দেশিত প্রাচীরের ধারে ঢলে গেলাম। পরমুহূর্তেই সে-
ও সেখানে হাজির হ’ল। সে বোরখার নাকাব সরিয়ে মিনতির
দৃষ্টিতে তাকাল। বলল --'অঃ তোমাকে দেখামাত্র আমার বুকের
ভেতরে কেমন যেন এক অভাবনীয় রোমাঞ্চ অনুভব করছি। শিল্পায়
শিরায় জেগেছে মাতন। আমার রাষ্ট্রের ঘুম তুমি কেড়ে নিয়েছ
পরদেশী: কেন এমন হ'ল? তুমি কি যাদুবিদ্যা জান? তোমার
যৌবন অম্লকে মাতাল করে দিয়েছে। মেহবুব, আমার মধ্যে কেন
তুমি এমন কামাগ্নি জাগিয়ে তুলেছ?'
—'আমার অবস্থাও ঠিক একই রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে মেহবুবা।
তোমার আঁখি-বাণ আমার কলিজাটিকে একেবারে ধাঝরা করে
নিয়েছে। কেন? কেন আমি এমন—
অন্ধাকে মুখের কথা শেষ করতে না নিয়েই, সে বলে উঠল
'মেহব। তুমি যাবে আমার ধরে। তোমাকে বুকের মধ্যে না
পাওয়া পর্যন্ত আমার কলিজা ঠাণ্ডা হবে না। অস্ত্র নয়। কল
বিকেলে একটি খচ্চরের পিঠে চপে আমার ঘরে এনো। ডিসে
করবে সিনডিক রবং-এর ঘরের ঠিকানা।
আমি ঠোঁটের কোপে হাসির রেখা ফুটিয়ে ভুলে
বললাম 'মেবা, অবশ্যই যাব। নইলে যে আমার কবিতাও
শান্তি বারি পারে না।
পরদিন দুপুর পেরোতে না পেরোতেই আমি একটি কালে
পঞ্চশটি সোনার মোহর বেঁধে আমার মনময়ূরীর খোঁজে বেরিয়ে
পড়লাম। লাল রঙের একটি বাড়ির সামনে আমি খচ্চরের পিঠ
থেকে নামলাম।
আমি দু'পা এগিয়ে দরজার কড়া নাড়লাম। দুটো থুবসুরহ
পেড়কি এসে দরজা খুলে আমার সামনে দাঁড়ান। এক নজরে
দেখেই মনে হ’ল তারা যেন বেহেস্ত থেকে সরে দুনিয়ায় গেলে
এসেছে। নতুবা পরীদেরই কেউ হবে হয়ত।'
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে রূপসীদের একজন বলল-
'আসুন হার। আমাদের মালর্কিন আপনার পথ চেয়ে সকাল থেকে
বসে। রাতভর আপনার সুরতের চিন্তার কাটিয়েছেন। আপনি তার
খুশী, উৎপাদন করা হুজুর।
আমি অপরূপাদের পিছন পিছন সুন্দর বাড়িটির ভেতরে ঢুকে
গেলাম। সমর দরজা থেকে শুরু করে উঠোন, বারান্দা, ঘরের
মেঝে সবই বহুমূলা শ্বেতপাথরের তৈরী। তারা আমাকে নিয়ে
মুনজ্জিত একটি ঘরে মেহগনি কাঠের একটি কুর্ণিতে বসাল।
কিসের এ পর্যন্ত বলা হলে বেগম শাহরাজাদ দেখলেন
প্রাসাদের বাইরে ভোরের আলো দেখা দিতে শুরু করেছে। তিনি
এবার কিসসা বন্ধ করলেন।
ছাব্বিশতম রজনী
সন্ধ্যার কিছু পরে বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে প্রবেশ
করলেন। উপস্থিত হলেন বেগমের কামরায়।
বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্সার পরবর্তী অংশ শুরু করতে
গিয়ে বললেন— 'জাঁহাপনা, কায়রোর সে-খ্রীস্টান দালাল তার
কিস্সা বলে চললেন।' অধীর আগ্রহে, একাগ্রচিত্তে সুলতান তার
কাহিনীর পরবর্তী অংশ শুনতে লাগলেন। খ্রীস্টান দালালটি এবার ব
বলল— 'জাঁহাপনা, সেই যুবকটি বলতে লাগল আমার জান,
আমার কলিজা সে-রূপসী মণি-মুক্তার গহনায় নিজেকে সাজিয়ে
তুলে ধীর-পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। পরণে তার অতিমিহি | হা
ঢাকাই মসলিম। তবু মনে হ’ল সে যেন একেবারেই নগ্না। তার
নিটোল স্তন দুটো খুবই স্বচ্ছ। আর নিতম্ব, উরু, জহ্বা সবই | ত
পরিষ্কার আমার আঁখি দু'টির সামনে ধরা দিচ্ছে। নগ্না এক নারীর চ
মুখোমুখি যেন আমি দাঁড়িয়ে।
CE
2
ঠোঁটের কোণে অত্যাশ্চর্য এক হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে
আমার মেহবুবা, আমার পেয়ারের বেগম আমার পাশে, একেবারে মু
গা-ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। তার আঠারো বছরের যৌবনভরা দেহের
উষ্ণ উপস্থিতি ঢাকাই মসলিনে ঢেকে রাখতে পারল না।
আমি নীরব চাহনি মেলে তার যৌবনকে চাক্ষুষ করতে দি
লাগলাম। কি করব, কি বলব সহসা গুছিয়ে উঠতে পারলাম না।
সেই অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করল। আচমকা আমার মুখটিকে তার
উষ্ণ-নিটোল বুকে চেপে ধরল। আমি যেন মুহূর্তে নিজেকে হারিয়ে অ
ফেললাম। এতদিন শুধু ভেবেই এসেছি, কি এমন অমৃতভাও নারীর
উন্নত স্তন দুটো বার ক্ষণিক স্পর্শের লোভে পুরুষরা ছোঁক ছোঁক
করে বেড়ায়। আজ বুঝলাম, কেবল অমৃতই নয়। তাতে রয়েছে
1 আকর্ষণীয় মাদকতা ওপ। পর মুহূর্তেই যে তার পদ্মের পাঁপড়ির
মত সুন্দর ঠোঁট দুটোকে নামিয়ে এনে আমার ঠোঁটে রাখল।
আহারে। কী সে সুখ, কী যে স্বক্তি তার বিচার করার ভাষা আমার
জানা নেই। আমার ঠোঁট ওর ঠোঁট—মধু বিনিময় – তৃপ্তি!
আমি কি করব, কিসে যে বেশী সঙ্গসুখ অনুভব করতে পারব সে
বোধশক্তি হারিয়ে ফেললাম।
=
=
=
3
সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। উন্মাদিনীর মত তার বুকের সঙ্গে
আমার প্রশস্ত বুকটিকে চেপে ধরল। আমি তার কাঁধের ওপর দিয়ে
২। হাত দুটোকে চালিয়ে দিয়ে শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তাকে
চেপে ধরলাম। আমার একেবারে বুকের সঙ্গে সে লেপ্টে রয়েছে।
তবু মনে হ’ল, আরও, আরও কাছে তাকে পাওয়ার জন্য মন প্রাণ
চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সে আবেশে জড়িত, কামাতুর চোখ দুটো
মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আবেগ-মধুর স্বরে বলল 'মেহবুব
আমার আজকের এ-সন্ধ্যা আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয়
মুহূর্ত। ওগো পরদেশী, তুমি আজকে কি সুখ, কী অবর্ণনীয় তৃপ্তি
আমাকে দিলে তা আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না!'
1
আমি তার আপেলরাঙা কপোলে আলতো করে একটি চুম্বন
5 দিয়ে বললাম – সুন্দরী, আমার অবস্থাও তোমারই মত। আজ এই
প্রথম মহব্বতের স্বাদ পেলাম। মহব্বত যে কী মধুর বস্তু তা আজই
প্রথম উপলব্ধি করলাম। ওগো সুখদায়িনী, আমার কলিজা আজ
অমৃতের স্বাদ পেয়ে ধন্য হল।'
সে আমার পৌরুষের চিহ্ন সম্বলিত লোমশ বুকে মাথা গুঁজে
আবার মধুর স্বরে বলল—'আমি এর আগে কোনদিন কোন
পুরুষের কাছ থেকে মহব্বত পাইনি। আমার শাদী হয়েছিল। এক
বুড়া আমার জীবনে এসেছিল। অগাধ ধন-দৌলতের মালিক। কিন্তু
নারীকে প্রকৃত সুখ আস্বাদন করানোর মত ছিল না বলতে, কিছুই
ছিল না। আমার কাছে সে ছিল অভিশাপ মাত্র। আজ তুমি আমাকে
পেয়ার মহব্বতে ভরিয়ে দাও, আকুল প্রাণকে শাক্ত-স্নিগ্ধ কর, তৃপ্ত
কর আঠার বছরের অতৃপ্ত মনকে। আমিও আমার সযত্নে রক্ষিত
সম্পদ তোমাকে উজাড় করে দেব। আমার এ-দেহ আর এ-মন
সবই তোমার মেহেবুব।'
রাত্রে পানাহার করলাম পাশাপাশি বসে। তারপর আমরা
জানালার ধারে গিয়ে বসলাম। পাশের বাগিচা থেকে ফুরফুরে
বাতাস এসে আমাদের কামোন্মাদ দেহ দুটোকে স্নান করিয়ে দিতে
লাগল। শীতল বায়ুর স্নান। এক সময় আমরা কখন যে আরও
কাছাকাছি হতে শুরু করেছিলাম তা বলতে পারব না। কখন যে
আমি তাকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম তা-ও যেন নিজেরই অজান্তে
ঘটেছিল। উভয়ে এবার নতুন খেলায় মশগুল হয়ে পড়লাম।
হল রুমে একে অন্যের কাছে হারিয়ে যেতে লাগলাম। তার =
শ্বে প্রবর্তি ছাড়া পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্রও ইস
যে মোমবাতিটি গলতে গলতে একেবারে নিঃশেষ হয়ে
গেছ বুঝতেই পারি নি। আর কতক্ষণ যে আমরা পরম প্রিয়
অন্ধকারের মধ্যে কাটিয়েছিলাম তা-ও সঠিক নিশ্চিত করে বলতে
পরব না। কতক্ষণ যে সে আমার বাহুলগ্না হয়ে ছিল তার হিসাবই।
অন্যদের কার ছিল না। আমার জীবনে এমন মধুকরা রাজি
আখৈ কোনদিনই আসে নি।
এক সময় রাঙি পোহাড়। ভোরের আলো জানলা দিয়ে ঘরের
মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। বিছানা ছেড়ে নেমে এলাম।
আমি আমার পরম সুখদায়িনী নেহৰুবার কাছ থেকে বিদায়
নেবার উদ্যোগ নিলাম। আমাকে দু’বার বন্ধনীতে জড়িয়ে ধরে
আকোভরা কণ্ঠে বলল—'মেহব, আবার করে তোমাকে আমার
হুকের মাঝে ফিরে পাব? কবে তোমার ধৌবন আমার যৌবনভরা
নেংটিকে সুগদান করবে?'
—'আঞই। আজ রাতেই আবার আমরা মিলিত হ’ৰ।'
সরাইখানায় গিয়ে ভাল করে গোসল করলাম। আমার হীরের
অংশ বিশেষের প্যাচপ্যাচানি দূর হ'ল। সামনা কিছু নস্তা করে
বভাবে ভাগাসায় বেরোলাম
সন্ধ্যার কিছু আগে পঞ্চাশটি স্বর্ণমুদ্রা কামিজের জেবে ঢুকিয়ে
উঠলাম আমার পক্ষীরাজ ঘরেটিং পিঠে।
আমি মেহবুবাকে বুকে স্তাড়িয়ে ধরে বারবার চুম্বনের মধ্য দিয়ে
কিছু করে তুলাম। নেশা! সুরার নেশার চেয়েও শক্তিশালী
এ ঘোরে সারাটি রাত্রি কি করে যে কেটে গেল বুঝতেও পারি।
Z
সন্ধ্যার কিছু পরে আবার পঞ্চাশটি ফ্লেমার মোহর জেবের
যায্যে ঢুকিয়ে উঠলাম আমার প্রিয়ঙ্গী খচরটির পিঠে।
u
কালে অবার সরাইখানায় ফিরে এলাম। পঞ্চাশটি সোনার
মেহের তার বালিশের তলায় রেখে এসেছি।
সারারাত্রি শরীর ও মনের ওপর খুবই ধকল গেছে। অক্রাচার। উ
দল সেরে বিছানায় আশ্রয় করতেই ঘুমের কোলে ঢলে
এভাবে একের পর এক রাত্রি আমরা পরস্পরের বছতোরে
অন্ধ হয়ে কাটিয়ে দিতে লাগলাম।
একদিন আমি ঠাহর করলাম। আমি নিঃস্ব রিক্ত হয়ে পড়েছি।
সালে অর্থ যা হিল কমতে কমতে একেবারে চরম দুরবস্থায় এসে
শৌচছে। অর্থ চাই। মোহর। সোনার মোহর। রোজ পঞ্চাশটি
করে সোনার মোহর যে আমার চাই ই চাই। কিন্তু কোথায় পাব
কাছে কিছু পাওনা নাই। হারা উদ্দেশ্যে রাস্তায় ঘুরতে লাগলাম।
হঠাৎ দেখি, এক সিপাহীর পিছনে কিছু লেড়কা ভিড় করে দাঁড়িয়ে
মজা দেখছে। আমি ভিড় ঠেলে তার গা-ঘেঁধে গিয়ে দাঁড়ালাম।
হঠাৎ তার ক্তেবে আমার গা ঠেকল। বুঝলাম, মোহরের থলে।
আলতো করে তুলে নিলাম। পারলাম না। সামলাতে পারলাম না।
সিপাহীটি চেঁচিয়ে উঠল—আমার মোহরের থলে গেল কোথায় ??
আচমকা আমার মুখে একটি ঘুষি লাগল। বিকট আর্তনাদ করে
মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। ঠিক তখনই সে-পথে কোতোয়ালকে
দেখা গেল। আমাকে তল্লাসী করা হ'ল। জেব থেকে সিপাহীর
মোহরের থলিটি পাওয়া গেল।
ARMIS
বামালসহ হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছি। অস্বীকার করার
। উপায় নেই। কোেতায়ালের নির্দেশে আমার হাত দুটো কেটে
ফেলার ব্যবস্থা করা হ’ল। ডান হাতটি কাটার পরে পথচারীরা
অনুরোধ করল যাতে অন্য হাতটি, আমার এ-বাঁ হাতটি কাটা না হয়।
কোতোয়াল অনুরোধ রক্ষা করল।
★
আমাকে নিয়ে পাশের দাওয়াখানায় গেল। দাওয়াই দিয়ে
প্রয়োজনীয় ইলাজ করল বুড়ো হেকিম।
=
।
এবার আমি বেঁ-হুসের মত ইটিতে হাঁটতে আমার মেহবুবার
বাড়ির দরজায় কখন যে হাজির হয়েছি, বুঝতেই পারিনি।
রাত্রের মেহবুব সকালেই হাজির হয়েছি দেখে সে খুবই অবাক
; হ'ল। আমার কাটা-ডানহাতটি রুমালে ঢাকা। সে কিছু বুঝতে পারে
নি। কিন্তু খেতে বসে বাঁ হাত দিয়ে খেতে দেখে সে অবাক হ'ল!
-
আমি তাকে শঙ্কামুক্ত করতে গিয়ে বললাম – ‘হাতে একটি
ফোঁড়া উঠেছে। বেঁধে রেখেছি।'
আমার হাতের ব্যথা কমাবার জন্য সে আমাকে সরাব এনে
দিল। পর পর দু’গ্লাস গলায় ঢেলে দিলাম।
শরীর এলিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ঘুম ভাঙলে
দেখলাম, আমার হাতের বাঁধনটির কিছুটা হেরফের হয়েছে।
বুঝলাম, ঘুমন্ত অবস্থায় হাতের বাঁধন খুলে সে দেখেছে। তারপরে
আবার বেঁধেছেদে রেখেছে। খুব লজ্জা হ’ল। সে কিন্তু কিছু বলল
না, একটিও প্রশ্ন করল না।
আমার ঘুম ভাঙতেই সে নীরবে এক পেয়ালা সরাব এনে
| আমার মুখের সামনে ধরল। আমিও নিতান্ত বাধ্য ছেলের মত এক
চুমুকে সবটুকু সরাব গলায় ঢেলে দিলাম।
আমি বেরোতে চাইলাম। সে রুখে দাঁড়াল। বলল—— 'আগে
তোমার হাতের ইলাজ করাতে হবে। এখান থেকে এক পা-ও
কোথাও যেতে পারবে না।'
আমি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না। তার বুকের
মধ্যে মুখ গুঁজে কৃত-অপরাধের জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে
লাগলাম। আর বারবার বলতে লাগলাম—'আমি চোর। চুরি করতে
গিয়েছিলাম। ধরা পড়ে আমার এ শাস্তি হয়েছে।'
—'কেঁদো না সোনা মাণিক। কেন ও কাজ করতে গেলে, বল
ভো?' লেফকিটি নিজেকেই দোষী সব্যস্ত করেছে। রোজ রাজে
ফুর্তি করার জন্য পঞ্চাটি করে সোনার মোহর তো আমাকেই
দিয়ে গেছে। এভাবেই তো সে আজ আমির থেকে ফকির বনে
গেছে। তামার গড়ে - মাথায় হাত রোশতে বোলাতে সে
বলল—'মেহবুর আমার, কোথাও যেতে হবে না তোমাকে। আমার
সম্পাই তো তোমার এরকম হয়েছে। তামাকেই তার প্রায়শ্চিন্ত
----আমি তো আর গুঁড়া ডেকা নই যে, তুমি আমার এ-
নশর জন্য শয়ী হবে। আমি তো স্বেচ্ছায়ই এগিয়ে এসেছি। কেন
হিছে নিভে কে কষ্ট দিক্ষ, অপরাধী বোধ করছ?' কথা বলতে বলতে
তাকে বুকে টেনে নিলাম। বাঁ-হাতটি তার পিঠে আলতো ভাবে
বুলাতে লাগলাম। বল্লাম—কেন তুমি মিছে নিক্লেকে অপরাধী
মনে করে কষ্ট পাচ্ছ? নিজের দোষেই তে| আমি ডান-হাতটি
খুইয়েছি। আমার নির্বুদ্ধিতাই এর জন্য দায়ী।
সে যাই হোক, আমি তোমাকে এখান থেকে থেকে
দিচ্ছিনে। তোমাকে আমি শদী করে জীবনসঙ্গী করে তবে আমার
যা কিছু সম্পর্ক আছে সবই তোমার হাতে তুলে দেন হাসা
করবে। তাতেই আমাদের সুখে-দুঃখে কোনরকমে দিন গুক্তরাপ
হয়ে যাবে।'
তার কথা শুনে আমি তো একেবারে থ বনে গেলাম। অন্তত
থেকে পেয়ার করতে না পারলে তে। এমন কথা বলা সম্ভব নয়।
সে আমাকে নিয়ে গেজ তার লোহার সিন্দুরের কাছে। নীল অর্থ,
সোনাদানা, হিরে-জহরৎ যা কিছু তার ছিল সবই, দেখল। আর
দেখলাম আমার দেওয়া নেহরগুলো তেমনি ভাগে ভাগে
সঞ্জালোই রয়েছে, সবই আমার হাতে ভালো দিয়ে শে
বলো ---নাও, এগুলো দিয়ে নতুন করে ব্যবসা শুরু করে দাও।
আমাদের বাঁচতে হবে। আর তার জন্য তোমাকে মাথা ভুলে
সাঁড়াতে হবে, মনে রেখো।
আমি নতুন করে আশার আলো দেখতে পেলাম। নতুন
জীবনের হোয়রে আমার মধ্যে ভর করল।
একটি ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। আমার মেহবুবার ধ্য
সর্বহা কেমন যেন এক অকণিত ব্যথা যন্ত্রণ। কাক্ত করে চলছিল।
ঘুমের ঘেরেও প্রায় বলতো—আমি, হ্যাঁ হ্রামিই ওর এ-হালত্তের
জন্য দায়ী। আমার জন্যই তো তাকে ডান হাতটি হোয়াতে হ'ল।
এ-দুঃখ আমি কোথায় রাখব ! আমার মত হতভাগিনীর মরণ হওয়া
এর চেয়ে ঢের ভাল।
আমি তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বলতাম—'মেহবুলা,
কেন সব ভুল খবহু বহু তো? আমার একটি হাত ছাড়া তো আর
কিছুই যায় নি। তারজন্য এত মর্মবেদনা ভোগ করছ কেন? একটি
হাত তো রয়েই গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, যার জন্য এতসব সেই ি
তুমি তো আমার পাশেই রয়েছ।'
হায় খোদা, আমরা কিন্তু সারাজীবন একসঙ্গে কাটাতে পারলাম
না। কী বিমারী যে তার ওপর ভর করল, আমি বুঝতেই পারিনি। ব
দূরদূরান্ত থেকে হেকিম নিয়ে এসে ইলাজ করালাম। কিন্তু তার
বিমারী সারল না। দিন দিন শুধুই শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেতে লাগল।
বুঝতে দেরী হ’ল না, আমার কাটা-হাতটির চিন্তাতেই তার ওপর
এমন বিচিত্র বিমারী ভর করেছে।
না, কোন চেষ্টাতেই ফল পাওয়া গেল না। কোন হেকিমের (
লওয়াই-ই ধরল না। একদিন আমাকে ফেলে সত্যিই সে বেহেস্তে
চলে গেল।
সে মারা যাওয়ায় তার যাবতীয় ধনদৌলতের মালিক আমি
হলাম। মনে মনে বল্লাম— 'হায় আল্লা, একী হ’ল। এত ধন-
স্নেত আমার কোন্ কাজে লাগবে? অর্ধেক বিক্রি করে দিলাম।
পঞ্চাশ মন ক্ষীরার বীজ ছিল, যা আপনার কাছে বিক্রি করেছি।
বিষয় সম্পত্তি যা আছে বেচে দেওয়ার ধান্দায় ঘুরছিলাম বলে
আপনার কাছে এসে ক্ষীরার বীজের দাম নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়
টি এখন আর নেওয়ার ইচ্ছাও নেই। আমি চাই, তা দিয়ে আপনি
ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত হোন। আপনার উন্নতি আমাকে আনন্দিত
করবে, মনে রাখবেন।
যুবকটি বলল –'এ-ই আমার জীবন কথা। তাই তো আজ
আপনার ঘরে বাঁ হাত দিয়ে খানা খেলাম, সরাব পান করলেন।
চাঁাঁহাপনা, আমি যুবকটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে
বলান,— 'তোমার করুণার কথা জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও
ভুলতে পারব না।
7
i
--'দেখুন, আজ আপনার সে-চার হাজার দিরহাম আমার
কাছে খুবই তুচ্ছ ব্যাপার। ধন-দৌলতের পাহাড় গড়ে ফেলেছি
আমি! বাগদাদ নগরে সম্প্রতি আমি এন্ড কারবার আরম্ভ করেছি।
আপনি আমার সঙ্গে কারবার করতে আগ্রহী হলে খুশীই হ'ব।'
আমি এক কথাতে রাজি হয়ে গেলাম। আলেকজান্ডা আর
কায়রো থেকে সমানপত্র এনে চড়া দামে বিক্রি করে কিছুদিনের
মধ্যেই একেবারে দিনারের কূর্মীর হয়ে গেলাম। কাল রাত্রে সরাব
একটু বেশীই গিলে ফেলেছিলাম হুজুর। তারপরই কুঁজো ওই
অষ্টাবকটির নাম নিয়ে ফ্যাসাদে পড়ে যাই।
বেগম শাহর:জাদ দেখলেন ভোর হয়ে এল বলে। তিনি কিস্সা
বন্ধ করলেন।
:
সাভার্শতম রজনী
=
পদশাহ শারিয়ার রাত্রে অন্দরমহলে বেগমের ঘরে এলেন।
বেগম শাহরাজাদ কোনরকম ভূমিকার অবতারনা না করেই
বিসসার পরবর্তী অংশ শুরু করলেন— 'ফছাপা, সে খ্রীস্টান
দালাল তার জীবনকথা শেষ করে সুলতানকে বলল - 'হুজুর,
কুঁঝো অষ্টক সে লোকটির মৃত্যুর জন্য যদি কাউকে দায়ী
করতে হয় তবে বলব তার নর্মাবই একমাত্র দায়ী।
-
সুলতান কিন্তু এত সহজে দমবার পাত্র নন। তিনি পূর্ব স্বর
অনুসরণ করে বললেন- 'তোমাদের কারো রেহহি নেই। এক এক
করে আমি সব ক'টিকে কোতল করব। আমার দরবারের এক হাস
রসিকণে ভোমরা খুন করেছ। আর আমি তোমাদের ছেড়ে দেব
ভেবেছ?'
এবার সুলতানের রসুইকর বদ – 'আঁহাপনা যদি অনুমতি
করেন তবে আমি অমর কাহিনী শুরু করি।
-- ঠিক আছে। তোমার বক্তব্যও তবে শোনহি যাক।”
শুনুন অস্থাপনা। আমর কিস্সা গুনে যদি আপনার
। মেজাজ শরিফ হয়, আমার কথা সত্য বলে মনে করেন তবে যারা
। আপনার চোখে অপরাধী মনে হচ্ছে। আশা করি স্বাহকে মাফ করে
দেবো।'
-
T
সুলতান মূল্যে পাস্তীর্ঘটুকু অব্যহিত রেখেই বললেন—'আচ্ছা,
পরের কথা পরেই না হয় ভাবা যাবে। কিস্সা শুরু কর। সত্যি যদি
মজার ব্যাপার কিছু থাকে তখন বিচার-বিবেচনা করে দেখব।'
—জাঁহাপনা, গতকাল আমার এক জিগরি দোস্তের বাড়ি
শাদীর ভোজ খেতে গিয়েছিলাম। বহু লেখাপড়া জানা এবং
গুণীজন সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। খানা সাজানো হ'ল। কত
রকম যে পাকসাক হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তাদের
মধ্যে জিরবাজা নামে রসুন ও মশলাপাতি সহযোগে পাক করা
একটি বিশেষ খাবারও ছিল। একজন ছাড়া আমরা সবাই রসুনের
জিরবাজা চেটেপুটে খেতে লাগলাম।
আমরা তাকে খাওয়াবার জন্য বার বার কোসিস করতে
লাগলাম। বল্লাম ——সামান্য একটুখানি চেখেই দেখুন না।'
—না, খাব না। এ-জিরবাজা খাওয়ার জন্য আমাকে একবার
খুবই খেসারত দিতে হয়েছিল।'
ব্যস, এ পর্যন্তই। আমরা তাকে জিরবাজা খাওয়ার জন্য বেশী
জুলুম করলাম না। কিন্তু ঘটনাটি কি? কেন এবং কিভাবে তাকে
খেসারত দিতে হয়েছিল তা বলার জন্য বার বার পীড়াপীড়ি শুরু
করে দিলাম আমরা।
এবার সে বল
'যদিও কোনদিন জিরবাজা খাই তবে
যাওয়ার আগে আমি কম করেও চল্লিশবার সাবান, চল্লিশবার সোডা
এবং পটাশ দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে নিয়ে তবেই খাব।'
বাড়ির মালিক তার হাত ধোওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়
সামগ্রীগুলো এবং এক বদনা পানি আনিয়ে দিলেন।
আমরা তার দুটো জিনিস গোড়া থেকেই লক্ষ্য করছিলাম—
‘প্রথমতঃ খুবই আস্তে আস্তে সে খাচ্ছিল, আর দ্বিতীয়তঃ ভার
| দু'হাতেরই বুড়ো আঙুল নেই, কাটা। আমরা খানাপিনা বন্ধ করে
তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একজন তো কৌতূহল নিবৃত্ত করতে
না পেরে জিজ্ঞেসই করে বসল – বলুন তো, আপনার হাত
পায়ের আঙুলগুলো খোয়ালেন কি করে?'
--আমার আব্বাঙ্গী একজন বণিক ছিলেন। বাগদাদের খলিফা
হারুণ অল-রসিদ-এর সময় তার ব্যবসা খুবই রমরমা ছিল।
সরাবের দিকে তাঁর ছিল খুবই ঝোঁক। বিভিন্ন দেশ থেকে সেরা
সরাব এনে ইয়ার দোস্তদের নিয়ে পান করতেন। আর দেশ
বিদেশের নামকরা বাইঙ্গীদেরও তিনি জোগাড় করে এনে গানের
মজলিস বসাতেন। পরিণামে যা হবার তা-ই হ'ল। মৃত্যুর পর তার
বিশাল দেনার বোঝা চাপল আমারই ঘাড়ে। আমি অবশ্য অল্প অল্প
করে সবার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলাম। ব্যবসায় নেমে পড়লাম। একদিন
উত্তমকে পোশাক পরিহিতা এক যুবতী খচ্চরের পিঠে চেপে আমার
দোকানে এল। বোরখার নাকারের ফাক দিয়ে তার মুখের যে-
অংশটুকু উকি মারছিল তাতেই আমার কলিজাটি চঞ্চল হয়ে
পড়েছিল। হায় আল্লা। মানুষের মুখ এত সুন্দরও হয়। তার পিছনে
গু সামনে একজন করে রোজা থুক, পাহারাদার।
সুন্দরী খচ্চরের পিঠ থেকে নেমে ধীর-মন্থর পায়ে বাজারের
দিকে এগোতে চেষ্টা করল। খোচ্ছাদের একজন পথরোধ করে
দাঁড়াল— 'ওদিকে ধাবেন না মালকিন। ও পথটি মোটেই ভাল নয়।
সে তার কথায় পাত্তা না দিয়ে সে পথেই ইটো জুড়ল। আমার
সোকানটি খুব সুন্দর করে সাজানো বলে ভেতরে ঢুকে এল। মিষ্টি
মধুর সুরেলা কন্ঠে বল—‘একটি ভাল শাড়ী কিনতে চাই। আছে
কি? থাকলে দেখাতে পারেন।'
আমি বাক্ত হাতে দোকানে যত ভাল ভাল শাড়ী ছিল দেখাতে
লাগলাম। তার পছন্দ হ'ল না। আমি শুন্য কয়েকটি দোকান থেকে
কয়েকটি শাড়ি আনিয়ে দেখালাম। সে কোথাও গেল না। আমার
দোকানে বসেই সব দেখল।
এক সময় সে মুচকি হেসে বলল – 'সে কী, মেয়েদের
পোশকের দোকান খুলে বসেছেন, অর ভাসের কি এবং কেমন
চাহিদা গোঁজ রাখেন না?'
আমি হাত কচলে বল্লাম— মাফ করবেন, একে আমি নতুন
ব্যবসা শুরু করেছি, অভিজ্ঞতাও নেই বললেই চলে।'
'অভিজ্ঞত! নেই? কেন? শাদী-নিকা করেননি?'
——সে সুযোগ আর হ'ল কই?'
আমার কথা শেষ হতে না হতেই সে আচমকা আমাকে লক্ষ্য
করে চোখের বাণ ছুঁড়ে দিল।
সে কিছু কাপড় চোপড় বাহুল। দাম পাঁচ হাজার দিরহাম। তার
কথা মত আমি সেগুলো বেঁধে ফেঁদে দিলাম।
খোঁজা প্রহরীদের একখান কাপড়গুলো হাতে নিয়ে দোকান
থেকে বেরিয়ে গেল৷ আর রূপসী যুবতীটি দোকান থেকে বেরিয়ে
খচ্চরের পিঠে গিয়ে বসল।
আমি বোকার মস্ত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
| কাপড়ের দামের কথা মুখ দিয়েই বেরলো না। দাম তো দিলই না,
এমন কি কবে সেধে তা পর্যন্ত বলল না। কাপড়গুলো অন্য দোকান
থেকে জোগাড় করে এনেছিলাম। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, এক
সপ্তাহের মধ্যে তাদের দাম শেখ দিয়ে দেব। একী মত দায়রে
বাবা।
এক সপ্তাহ চলে গেল। সে-রূপসীর আসা তো দূরের কথা দাম
| পর্যন্ত পাঠাল না। ঠিকানাও জানি না যে, তাগাদা দিতে যাব। আচ্ছা
ষাঁতাকলে পড়া গেল: পাওনাদারদের কাছ থেকে আরও এক
সপ্তাহের সময় চেয়ে নিলাম।
নসীবের ফ্লোর আছে আমার। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ দিন
খচ্চরের পিঠে চেপে সে-রূপসী আমার দোকানে এল, একটি
সোনার হার আমাকে দিয়ে বলল— 'এটি বিক্রি করে যা দাম হয়
তা নিয়ে আপনার পাওনাগণ্ডঃ সিঁটিয়ে নিন।
আরও কয়েকটি কাপড় চাইল।
পাশের দোকান থেকে কিছু ভাল ভাল কাপড় দেখালাম। পছন্দ
করল। দশ হাজার দিরহাম দাম হ'ল। আগের দিনের মতই খোজা
প্রহরী কাপড়ের গাট্টি নিয়ে পথে নামল।
আর রূপসী যুক্তীটি নিজে গিয়ে বসল খচ্চত্রের পিঠে। আমি
এবারও নীরার ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। দাম চাওয়া
দূরের কথা টু-শব্দটিও করতে পারলাম না।
আগের বারে ছিল পাঁচ হাজার, এবারে দশ হাজার দিরহামের
দায় ঘাড়ে চাপল। কী রকমারিতেই না পড়া গেল।
ঠগবাষা মেয়েদের কথা আগে বহুবার শুনেছি। আজ একেবারে
নিজেই আমি তার হারে গড়লাম। আসলে তার রূপের লালে
জড়িয়েই আমার এ-সর্বনাশ ঘটল।
শেষ পর্যন্ত দোকানটি বেড়ে দেনা শোধ করব মনস্থ করেছি
ঠক তখনই একদিন আমার রূপসী সঙ্গীরে হাজির হ’ল। আমার
সামনে একটি থলি রাখল। ওজন করে দেখি, আমার প্রাপ্যের
চেয়ে বেশীই আছে। সে বলল, – আপনার কাছেই সব রেখে
"
আমার রূপসী আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল— 'শাদীটানী করবেন
—বিয়ে শাদী আর নসীবে আছে?'
—'এখন সুঠাম সুখী আপনি যে কোন লেড়কির তো
আপনাকে দেখেই উতলা হয়ে পড়ার কথা।
-'একমাত্র আপনি ছাড়া আর কোন মেয়েই এরকম প্রসঙ্গ
ভুলেও আমার সঙ্গে পাচ্ছে না।'
সে নীরবে এমন ভঙ্গীতে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে
ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলল যা দেখে আমার বুকের
ভেতরে এগিতাটি রীতিমত উত্থালি পাথালি শুরু করে দিল।
একটি চমৎকার হন্দি মাথায় এল। দোকান থেকে বেরিয়ে
রূপসীর সঙ্গী খোজাটির হাতে একমুঠো দিনার দিয়ে বললাম—
'শোন, তোমার মাপকিনের মহব্বতে অটিকা পড়ে গেছি। তুমি
আমার হয়ে তাকে মহব্বত জানাবে। এখন এগুলো রাখ, পরে
আরও পাবে।'
-- আমাকে আর আপনার হয়ে ওকালতি করতে হবে না
হুজুর। অনেক আগে থেকেই আমার মালকিন মহব্বতের শায়রে
হাবুডুবু খাচ্ছেন। বুঝছেন না, কেন ঘুরে ফিরে তিনি এখানে
আসেন?'
আমি দোকানে ফিরে এলাম। সে ঠোঁট টিপে হেসে দল—
'কি? কি প্রামর্শ করে এলেন?'
– না, পরামর্শ আবার কিসের? আপনাদের ঠিকানাটি ব্রিে
করছিলাম।'
—'কেন বলুন তো? আমি না এলে আর দেখাশোনা না হলে
আপনি মর্মবেদনা অনুভব করবেন বুঝি?' উঠতে উঠতে বল
অনেক বেলা হয়ে গেছে। তাজ উঠি।
— একটি কথা বলার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় নি।
আপনার রক্ষীটি আমার হয়ে আপনাকে বলবে।
মুচকি হেসে সে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি তার আদর্শনে পৌনেমরা হয়ে গেলাম। রোজই পথ চেয়ে
পরি
একদিন তার খোজা রক্ষীটি বিষঃমুখে এসে বলল, তার
মালদিন অসুস্থ। শয্যা নিয়েছেন।
আমি তাঁর পরিচয় জানতে চাইলাম।
– খলিফা হারুন-অল-রসিদ-এর বেগম জুবেদার পালিতা
কন্যা আমার মালকিন। বেগম একে দত্তক নিয়েছিলেন। সেদিন
মায়ের অনুমতি নিয়ে আপনার কাছে মালপত্র কিনতে এসেছিল।
মেয়ে পছন্দসই গণ্ডা করে নিয়ে যাওয়ায় তাঁর মা খুবই খুশী হল।
একদিন তিনি মায়ের কাছে আপনার কথা পাড়বেন। আপনাকে
মনে ধরেছে, আম্মার কাছে তা বললেন। বেগম সহবা আপত্তি
করলেন না, তবে নিজের চোখে পাত্রকে দেখে তবেই লেড়কির
| কথায় পুরোপুরি মত দেবেন। নিকা শাদীর ব্যবস্থা করবেন। এখন
আপনার ওপরেই স্বকিছু নির্ভর করছে। আপনি কি বেগম
সাহেবার সঙ্গে মোলাকাৎ করতে রাজি আছেন?"
– আমি তো একপায়ে খাড়া। কিন্তু কবে, কোথায় তার সঙ্গে
মোলাকাৎ হতে পারে, বল।'
—আজ সন্ধ্যাতেই। টাইগ্রিস নদীর ধারে বেগম জুবেদার যে
বড় মসজিদ রয়েছে সেখানে আপনি নামাজ করতে যাবেন। নামাজ
সেরে ঘুমিয়ে পড়বেন। তারপরের কর্তব্য আমার।'
আমি খোজা প্রহরীটির পরামর্শমত টাইগ্রিসের ধারের মসজিদে
গিয়ে নামাজ পড়লাম। তারপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কাকডাকা
ভোরে কাঠের বাক্স ও খোজা ক্রীতদাসে ভর্তি একটি নৌকো ঘাটে
ভিড়ল। আমার প্রাণ-প্রেয়সী সে-সুন্দরীও সঙ্গে রয়েছে দেখলাম।
সে আমাকে আদরে-সোহাগে বিহ্বল করে তুলে বল—— ‘এ বাক্সে
তোমাকে পুরে তালাবদ্ধ করে নিয়ে যাব। করলও তা-ই।'
তালা খুলে আমাকে যখন বাক্স থেকে বের করা হ’ল তখন
তাকিয়ে দেখি, আমি প্রাসাদাভ্যন্তরে অবস্থান করছি। দাসী পোশাক
| পরিয়ে দিল আমাকে। এবার বেগম জুবেদা এসে হাজির হলেন।
আমাকে বসতে বলে আমার নাম-ধাম-পেশা প্রভৃতি জিজ্ঞেস
করলেন। আমার কথায় তিনি খুবই সন্তুষ্ট হলেন। মুচকি হেসে
বলেন –দিন দশেকের মধ্যেই তোমাদের শাদীর ব্যবস্থা করে
ফেলব। আর সে-দশদিন তুমি আমাদের প্রাসাদেই থেকে যাবে।
নৌকো থেকে অতিকায় কয়েকটি বাক্স মাঝিমাল্লারা ধরাধরি
করে নামাল। তাদের মধ্যে আমার পরিচিত সে-খোজাটিও রয়েছে
দেখলাম। আমার মেহবুবা বাদশাহের লেড়কি তার পাশে। আমাকে
তার ভবিষ্যৎ ইচ্ছার কথা বলল। আদর-সোহাগ ত করল খুব করে।
তারপর আমাকে বাক্সবন্ধী করে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা
বল্ল। আমি মুচকি হেসে বাক্সের ভেতরে ঢুকে বসলাম। তালা বন্ধ
করা হ'ল। তোলা হ'ল নৌকোয়। বাক্স খুলে বের করার পর
চারদিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি, আমি হারেমে অবস্থান
করছি। গোজার নির্দেশে ঘণ্টা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কুড়িজন
সুদেহী ও সুশ্রী যুবর্তী পরিচারিকা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বেগম জুবেদা ধীর-মন্থর গতিতে, সুন্দর ভঙ্গিমায় সুপ্রশস্ত
নিতম্ব দুলিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার নাম, সাকিন
ও পেশা প্রভৃতি এক এক করে খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
| তারপর মুচকি হেসে বললেন— 'আমি প্রীত। দশদিনের মধ্যে
তোমাদের শাদী-নিকা দেব। একদিন প্রাসাদেই তুমি থাকবে।'
একদিন খলিফা যৌতুকস্বরূপ দশ হাজার সোনার মোহর
পাঠিয়ে দিলেন। বেগম নিজে দিলেন পঞ্চাশ হাজার দিনার। কাজী
উপস্থিত হয়ে শাদীর কবুলনামা লিখলেন। সাক্ষীরাও যথা সময়ে
এসে গেল। আমাদের শাদীর কাজ মিটে গেল। জোরদার
খানাপিনার ব্যবস্থা হ’ল। সরাধের জোয়ার বয়ে গেল। আমি আশ
মিটিয়ে ‘জিরবাজা’ স্লোম। লোভ সামলাতে না পেরে
মাত্রাতিরিক্তই হয়ে গিয়েছিল। উঠে হাত মুখ ধোয়ার মত ক্ষমতাও
যেন ছিল না।
তারপর জনানারা আমাদের নিয়ে কী সব স্ত্রী আচার করল
আনন্দ করে। তারপর নিয়ে যাওয়া হ’ল ফুলশয্যার সজ্জিত বাসর
হ
ঘরে।
র
একদল পরিচারিকা আমার সদ্য শাদী করা বিবিকে নিয়ে এল।
প্রচলিত প্রথানুযায়ী তাকে একেবারে বিবস্ত্রা করা হ’ল। সবার
সামনে তার শরীরের যৌবনচিহ্নগুলিকে আমার কাছে তুলে ধরাতে
সে যেন শরমে মরে যাচ্ছিল। তার গালদুটো হঠাৎ পাকা আপেলের
মত লাল হয়ে উঠল। সে হাত দুটো দিয়ে নিজের শরীরের গোপন
জায়গাগুলিকে চাপা দেওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
।' বরাত ভাল যে, পরিচারিকারা তাকে উলঙ্গ অবস্থায় পালঙ্কে শুইয়ে
দিয়ে বাসরঘর ছেড়ে গেল।
ন
ন
J
আমি আর আমার মন-ময়ূরী বিবি ছাড়া ঘরে তৃতীয় কোন প্রাণী
। নেই। আমরা পাশাপাশি গা-ঘেঁষাঘেঁষী করে শুয়ে। আমি এক
ঝটকায় তার যৌবনের জোয়ার লাগা বিবস্ত্র দেহটিকে বুকে টেনে
নিলাম। ব্যস্, শরীরের সর্বশক্তি নিয়োগ করে অকস্মাৎ সে আমাকে
একটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। বিকট আর্তনাদ বেরিয়ে এল
মরে গেলাম। মেরে ফেল। কী উৎকট গন্ধ। আর পারছিনা
মরে গেলাম। আমি ব্যস্ত হয়ে বল্লাম--“কি? কি হ’ল মেহবুবা?’
গ
—‘রসুন! জঙ্গলীটি রসুন খেয়ে এসেছে। কী উৎকট গন্ধ গা
বমি বমি করছে আমার। আজ-জঙ্গলী-বনমানুষকে আমি শাদী করে
জীবনসঙ্গী করেছি। আমি ঘৃণাক্ষরেও জানতে পারি নি অসভ্য
জঙ্গলীটি এমন করে রসুনের ভক্ত। হতচ্ছাড়াটি ভুলেও আগে বলে
নি তার এ কু-অভ্যাসের কথা।'
3
व
আমি তাকে প্রবোধ দিতে গিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলাম।
র থামিয়ে দিয়ে সে খেঁকিয়ে উঠল— ‘একটি কথাও বোলো না। রসুন
যদি সেরেই থাক তবে কেন গরম পানি দিয়ে ভাল করে হাত মূহ
খ়োও নি।' কথা বলতে বলতে সে রুমালে মুখ ঢেকে ডুকরে করে
কাঁদতে লাগল।
আমি তাকে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে চেষ্টা করালম, এন্ড –
ঝটকায় আমার কাছ থেকে বেরিয়ে তিন পায়ে পাশের ঘরে চলে
গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একটি ১মিড়ার চাধুক নিয়ে ফিরে
এল। সুতীব্র আক্রোশে আমার পিঠে সপাং সপাৎ করে চাবুকের ধা
মারতে লাগল। আমি বিস্ময় ও যন্ত্রণায় বারবার কুঁকড়ে যেতে
লাগলাম। খালার দুই আঘার মাঝপনে প্রচণ্ড ফোরে চাবুকের হা
পড়ায় আমি পালাবার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলাম।
এবার তারস্বরে কোতোগলকে ডাকল। সে এলে হিংস্র
বলিনীর মত গর্জে উঠল – 'একে নিম্নে যাও। যে-হাত দিয়ে এ
রসুন খেয়েছে সে-হাতটি কব্জি থেকে কেটে হেলে।'
চিৎকার টোমেচি শুনে পরিচারিকারা ছুটে এল। তারা আমার
| হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে এলবের মত ছেড়ে দিতে সনির্বন্ধ অনুরোধ
করতে লাগল। আমার বিবি ক্ষমা করল। কিন্তু বে-কসুর খালাস
করে দিতে রাজি ন
বাস্যঘরে আমাকে একা ফেলে রেখে বাইরে থেকে তালা
করে দিল। ছানালা দিয়ে পানি থানা নিত। আমার বিবি দশদিন পর
পরিচারিকদের নিয়ে পরা খুলে আমার কাছে এল
পরিচারিকাদের চক্ষা করে বল্ এর গায়ে এমন একটি চিহ্ন
এঁকে দেব যাতে জিরবাজা'র কথা এর স্মরণ থাকে।
আমার নির্বির নির্দেশে পরিচারিকারা আমাকে পিঠমোড়া করে
বেঁধে ফেলুদ। তার ধারালো একটি ছুরি দিয়ে ঘাড় ঘাচে করে
অ:মার হাত পায়ের সব ক'টি বুড়ো আঙুল একেবারে গোড়া থেকে
কেটে ফেল্ল। কী যন্ত্রণাদায়ক, কী মর্মান্তিক ও অমানবিক কাজ।
বধূ অপরাধে এমন গুরুদণ্ডের কথা আপনারা কেউ শুনেছে
কেনদিন?
সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে আমি উন্মাদের মত চিৎকার করে বলতে
লাগলাম – 'ভবিষ্যতে আর ঝেমদিন ভুলেও জিৎবাজা খাব না।
আর যদি খাইও তবে চল্লিশবর পটাশ, চল্লিশনার সাবান এবং
চল্লিশার সোডা দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে তবেই পাখ।'
—'দোস্ত, আমার ফিরবাজান খাওয়ার জন্য আমার গোস্তলি
মা করবেন। আমি বিবির কাছে হলফ করেছিলাম। সে আম
বুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে বটে। কিন্তু কসম তো বোদাতাল্লার মানেই
করেছিলাম।'
রসুকের দুবার বলল- 'জহাপনা, আমি সে বাগদাদের
বণিককে জিজ্ঞাসাহাড় করেছিলাম —'খোদাতামার নামে শাহা
করে জিরবাক্তা ছড়ালেন, ভাপ কথা। কিন্তু পরিশ্রমে কি হ'ল?
–‘খোদাতাল্লার নামে শপথ করায় আমার বিবির দিলটি একটু
বগলে গেল। আমাকে মাফ করে দিল। তারপর আমরা বেশ
কিছুদিন অন্য দশজন মিঞা-বিবির মতই এক সঙ্গে ঘর সংসার
করেছিলাম।
r
আমার বিবি পঞ্চাশ হাজার সোনার মোহর দিল একটি বাড়ি
কেনার জন্য। সুন্দর একটি বাড়ি কিনালম। একবছর আমরা সেখানে
বাস করেছি। বছর পেরোবার আগেই সে দুনিয়া ছেড়ে বেহেস্তের
পথে যাত্রা করল! ব্যস, সব বেচে দিয়ে আমি হারা উদ্দেশ্যে পথে
নেমে পড়লাম। বহু দেশের পানি খেয়ে শেষ পর্যন্ত আপনাদের
মুলুকে এসে হাজির হলাম।
i
রসুইকর বলল— 'জাঁহাপনা, বাগদাদের বণিকের কাহিনী
সংক্ষেপে আপনার দরবারে পেশ করলাম।'
নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে আমরা বেরিয়ে যে, যার আস্তানার পথে
পা বাড়ালাম। রাত্রি তখন দ্বিতীয় প্রহর। তারপর কুঁজোটির লাশ
নিয়ে যা কিছু কাও ঘটেছে সবই তো এক এক করে শুনলেন।
চীন দেশের বাদশাহ এবার বিতৃষ্ণার সঙ্গে বললেন – 'তোমরা
যে, যা কিস্সা শোনালে তাদের একটিও চমকপ্রদ নয়। ঘটনার
⇒ বাঁধন তো নেই-ই। এর চেয়ে বরং হতভাগ্য কুঁজোটির মৃত্যুর
কাহিনী অনেক বেশী আকর্ষণীয় । অতএব তোমাদের ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হচ্ছেই।'
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
জয় গুরু
বিশুদ্ধ প্রচারের স্বার্থে -
আপনার যে কোন মন্ত্যব, অভিযোগ, অনুরোধ আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান। ...