বাদশাহ যখন ক্রোধ প্রকাশ করে কুঁজোটির মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত
লোকগুলোর শাস্তির চিন্তা করছেন তখন বৃদ্ধ ইহুদী হেকিম
বলল—'জাঁহাপনা, এবার আমাকে কিছু বলার জন্য মেহেরবানী
করে সুযোগ দিন। আশা করি আমার কিস্সা আপনাদের মনে দাগ
কাটতে পারবেই।'
বাদশাহ অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুমতি দিলেন।
বৃদ্ধ ইহুদী হেকিম তার কিস্সা শুরু করতে গিয়ে বলল—
‘জাঁহাপনা, কিস্সাটি আমি কিশোর বয়সে শুনেছিলাম। আমি তখন
দামাস্কাসে বাস করি। হেকিমি বিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করছি।
ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ শেষ করে আমি এদিকে ঝুঁকি।'
এক সকালে স্থানীয় সুবেদার পেয়াদা পাঠিয়ে আমাকে ডেকে
নিয়ে গেলেন। বিশাল ইমারতের লম্বা বারান্দা দিয়ে এগিয়ে
সুসজ্জিত একটি ঘরে ঢুকলাম। দেখি মেহগনি কাঠের কারুকার্য
মণ্ডিত পালঙ্কে এক কিশোর শুয়ে। রোগশয্যায়। আমি সমবেদনার
স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম— 'কি হয়েছে বাছা?'
সে নীরবে, চোখের ইশারায় কি যেন বোঝাতে চেষ্টা করল।
আমি হাত দেখতে চাইলে সে বাঁ-হাতটি বাড়িয়ে দিল। এরকম


অশিষ্ট আচরণে আমি খুবই ক্ষুব্ধ হলাম। ভাবলাম সম্ভ্রান্ত ঘরের
যুবক, সাধারণ সৌজন্যবোধটুকুও শেখেনি। বাঁ হাতের নাড়ি দেখে
দাওয়াই দিয়ে এলাম। তারপর দিনও গেলাম। পরদিনও যেতে
হ’ল। দশদিন চিকিৎসা করে তার রোগ কিছু নিরাময় করা গেল।
সুবেদার ইনাম দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করলেন। আর দামাস্কাসের
প্রধান হাসপাতালে চাকুরী দিয়ে কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিলেন।
প্রতিদিনই একবার করে আমার রোগীটিকে দেখতে যাই। কিন্তু
একটি ব্যাপার আমার মনের কোণে বার বার উঁকি দিতে লাগল-
‘সে রোজই কেন বাঁ-হাতটি এগিয়ে দেয়? সত্যি কি সৌজন্যবোধের
অভাবই এর জন্য দায়ী নাকি অন্য কোন গূঢ় কারণ এর পিছনে
রয়েছে। দশদিন পরে গরমজলে গামছা ভিজিয়ে তার গা মুছিয়ে
দিতে বললাম। সুবেদার অনুরোধ করলেন এ কাজটিও যেন আমি
উপস্থিত থেকে সম্পন্ন করি। তার পা জামা কামিজ সব খুলে
ফেলতেই আমার আঁখিতে প্রথম ধরা পড়ল— তার ডান-হাতটি
কাটা। আর সারা গায়ে চাবকের দাগে ভর্তি।
আমি বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
যুবকটি বল—'হেকিম সাহেব, খুবই অবাক হচ্ছেন, তাই না?
অবাক হবার কথাই বটে। এ কিন্তু আমার জন্মলগ্ন থেকে ছিল না।
সে অদ্ভুত কিস্সা অবশ্যই বলব। তবে এখন নয়, পরে।'
যুবক আমাকে নিয়ে ওপর তলার এক নিরিবিলি ঘরে গেল।
রসুইকারকে খবর পাঠাল ভেড়ার কাবাব করে সেখানে পাঠিয়ে
দিতে।
খেতে খেতে একথা সে কথার পর আমি তাকে বললাম-
'আপনার প্রতিশ্রুত সে-কাহিনী এখন বলবেন কি?


যুবকটি বাঁ-হাতে ভেড়ার কাবাবের থালাটি কাছে টেনে নিয়ে
বলেন—'শুনুন তবে আমার কাহিনী বলছি- মসুল নগরে
আমার জন্ম হয়েছিল। খানদানি পরিবার আমার আব্বা আর
চাচারা দশ ৬াই। আমার আব্বা সবার বড়। আমার দাদামশাই
নিজেই দৃশ লেড়কাকেই শাদী দিয়ে ঘর-সংসার পেতে দিয়ে যান।
আমার বাবা ছাড়া আমার চাচাদের কারোরই কোন বাচ্চটচ্চা হয়
নি। তাই আমি ছিলাম চাচাদের চোখের মণি! আদরের দুলাল।
এক সুম্মাবারের ঘটনা। সেদিন আমার আব্বা আর চাচারা
মসূলের বৃহত্তম মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেন। আমিও তাদের
সঙ্গে যাই। নামমকের পর অন্যান্য সবাই মসজিদ ছেড়ে নিজের
নিজের ঘরে ফিরল আমার আব্বা আর চাচারা কেবল রয়ে
গেলেন। চাচারা বাণিজ্য করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে
পাগলেন। শেষ পর্যন্ত মিশরে যাওয়াই সাব্যস্ত করলেন। নীলনদের
ভীরে সে দেশের প্রধান নগর ও কদর। দুনিয়ার বহুতে দেশ ছুঁড়ে
বেড়িয়ে তাঁরা বুঝেছেন, মিশরের মত মনোরম বেশ ভামাম দুর্নিয়ায়
দ্বিতীয়টি আর নেই। সেখানে গেলে নাকি মনে হর দুনিয়ার দুঃখকষ্ট
২ ভুলে ভিন্দুলুকে অবস্থান করছি।
|
বেহেস্তের মত সুন্দর এক দেশ চাক্ষুষ করার জন্য আমার দিপ
ইটফটানি শুরু করে দিল। আব্বাকে আমার উঐকান্তিক ইচ্ছার কথা
জানালাম। প্রথমে আমাকে এত দূরে পাঠাতে রাজি হলেন না। শেষ
পর্যন্ত আমি আশহত হই ভেবে দামস্কাস পর্যন্ত গিয়ে ফিরে
আসব, এ শর্তে রাজি হলেন।
আমাদের জাহাজ মসুলি বন্দর থেকে দাাস্কাসের উদ্দেশে
যাত্রা করল। আলেপ্পো নগর হয়ে পৌঁছলাম দাঙ্গাস নগরে।
জানা-অজনা গাছপালা আার ফুল ফলের বার্ণিচায় ভরা বেহেস্তের
মত সুন্দর দামাস্কাস নগর। তারই পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে
কঙোলিনী নীলনদ। অমি এক রাইখানার মাথা পৌঁছলাম আর
চাচার বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে নগরে ঘোরাফেরা করতে চলে
গেলেন। তারা মসুল থেকে আনা সমানপত্র বেচলেন। শ্রাবার
শমাস্কাস থেকে দুষ্প্রাপ্য বহু কিছু সওদা করে জাহাজ বোঝহি
করলেন।
আমার চাচারা কাজ মিটিয়ে যাত্রার উদ্যোগ নিলেন। আমার
দামাস্কাস ছেড়ে যেতে মন চাইল না। রয়ে গেলাম। তারা আমার
মুনাফার বখরা মিটিয়ে দিয়ে গেলেন।
আমি নীলনদের লাগোয়; সুন্দর একটি বাড়ি ভাড়া করলাম।
'ভাড়া দু' দিনার
এক বিকালে নদীর দিকে মুখ করে আমি বারান্দায় বসে সরাব
পান করছি। দেখলাম, এক রূপসী যুবতী আমার সামনে এসে
দাড়াল। অষ্টাদশী বলা যাবে না – লেড়শী।



তার নাকাবের ফাঁক দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে, সাধ্যমত তার নজর
এড়িয়ে ফুলের মত সুন্দর মুখটিকে দেখার লোভটুকু সামলাতে
পারলাম না। মুহূর্তের মধ্যেই সে বোরখার্টি খুলে পাশে রাখল। তার
মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ার জোগাড় হ'ল।
রূপের আভায় আমার আমাকে সচকিত করে তুল্ল। কোন
মানুষের মুখ এত সুন্দর হতে পারে ইতিপূর্বে কল্পনাও করতে পারি
নি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে রূপসী বল্ল কি গো ভাল
মানুষ, একা একা বসে যে? বিবি কোথায়?'
—বিবি পাব কোথায়? শাদী হলে তো বিবি পাশে থাকবে।'
——সে কী গো ! এমন জোয়ান বয়স? দেহে যৌবন বন্দী হয়ে
রয়েছে। আর বলছ কিনা, শাদী হয় নি! কথা বলতে বলতে আমাকে
লক্ষ্য করে আঁখিঁর বাণ ছুঁড়ে মারল। এবার বল– ফেঁয়ে ছেলে
ছাড়া রাত কাটাও – বলছ কি! এমন এক নাগর পেলে সব মেয়েই
মনে করবে যে আসমানের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
আমি খুবই বিব্রত বোধ করতে লাগলাম, একে নতুন জায়গা
একেবারেই ভিনদেশ। তার ওপর এমন রূপসী এক যুক্ত্রী যাকে
কোনদিন চোখেও দেখিনি। সে যদি প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই এমন
সব কথা বলে তবে যেকোন যুবাই মিইয়ে যেতে বাধ্য। আমি
সামান্য সরে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলাম।
মেয়েটি কিন্তু অধিকতর সাহসিকতার পরিচয় দিল। আচমকা
আমার একটি হাত চেপে ধরে সুন্দর ভঙ্গিতে চোখ-মুখ বিকৃত করে
বলে উঠল— 'কী ন্যাকামি রে। মন বলছে খাই খাই, আর মুখে
বলছে সাধ নেই।'
কথাটি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই এক ঝটকায় আমাকে টেনে
দাঁড় করিয়ে দিল। গলা জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। বাস, আছাড়
মেয়ে নিজে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বুকের কাপড়টুকু পাশে পড়ে
গেল। আর পায়ের কাপড় উঠে গেল হাঁটু ছাড়িয়ে উরুর ওপরে
—নিতম্বের কাছাকাছি। আমার শিরা-উপশিরায় রক্তের গতি
অকস্মাৎ বৃদ্ধি পেল। এক অভূতপূর্ব মাদকতা ভর করল আমার
দেহ-মনে। আমি কি করব ভেবে ওঠার আগেই তার তুলতুলে হাত
দুটো দিয়ে আমাকে সাঁড়াশির মত আঁকড়ে ধরল। যেকোন পুরুষের
পক্ষেই আকাস্ট্রিক্ষত তার যৌবনের জোয়ারলাগা বুকে আমার
প্রশস্ত বুকটি একেবারে লেপ্টে গেল। কাঁ যে রোমাঞ্চ জাগল আমার
মনে, আর আগুনের বন্যা বয়ে চলল শিরায় শিরায়। অনাস্বাদিত
পুলকে আমি বিমোহিত হয়ে পড়লাম। এবার সে তার স্পঞ্জের মত
নরম, আপেলরাঙা ঠোঁট দুটোকে ধীরে ধীরে নামিয়ে আমার ঠোঁট
স্পর্শ করল। অপূর্ব কৌশলে আমার নিচের ঠোঁটটিকে কামড়ে
ধরল। উন্মাদিনী প্রায় দিল এক কামড় বসিয়ে। সে-ও যেন মুহূর্তে।



—আর। তার রূপ সাগরে একেবারে তলিয়ে গেলাম। তার
যৌবনের উন্মাদন! আমাকে গ্রাস করে ফেল। সে-ও আমার
যৌনদীপ্ত সুঠাম দেহের দন, পেষণ ও সন্তোগসূর্য গাভ করে
পরম তৃপ্তিতে কানায় কানায় মনকে ভরে নিতে লাগল। দীর্ঘ সময়
■ ধরে আমরা পরস্পর পরস্পরের সমমূখ লাভ করে তৃপ্তিটুকু
একেবারে নিঃশেবে নিওড়ে নিয়ে এক সময় বিছিন্ন হলাম।
7
I
নিজেকে হারিয়ে ফেন্সন্স। মুক্তোর মত ঝকঝকে তার দাঁতের চাপে
আমার ঠোঁট যে কখন কেটে গেছে তা উপলব্ধি করার মত
বোধশক্তি সে মুহূর্তে আমার মধ্য থেকে সম্পূর্ণরূপে অন্তর্হিত হয়ে
গিয়েছিল, অস্বীকার করার উপায় নেই। আমিও বেল তখন
উন্মাদদশ! প্রাপ্ত হয়েছিলাম। এক ঝটকায় তার কোটিদেশ থেকে
ফিনফিনে কাপড়ের টুকরোটি খুলে ছুড়ে ফেললাম মেঝেতে।
তারপর? তারপর কি হ'চ্ছ সে-কথা কারো কাছে মুখফুটে বলার
নয়।
1
ক্লান্ত অবসর শরীরে অনেক বেলা পর্যন্ত আমি বিছানা আঁকড়ে
পড়েছিলাম। আমার সে-রাত্রের বেগম সে লেড়ক্টিটিও অচৈতন্যের
মত পড়েছিল। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সে বিবস্ত্র হয়ে
আমার গলায় একটি হত তুলে দিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে।
-আমি বিমুগ্ধ নয়নে তার দেহপল্লবটিকে এবার খুটিয়ে খুটিয়ে
1
নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। এমন যৌবনের মাতনলার রূপসী-
= যুবতীর দেহকে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কুরেকুরে খেয়ে আমার
সন্তোগসুখ লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল যেন বিশ্বাসই করতে
পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল সে কি ঘুমের ঘোরে দেখা খোয়ত্ব,
নাকি বাস্তব ?
সে-রাত্রের স্মৃতি, জীবনের প্রথম সম্ভোগ-সুখের কথা কোনদিন
আমার মন থেকে মুছে যাবে না। শুনেছি, জীবনের প্রথম সহবাসের
রাত্রির কথা নাকি সবারই অন্তরের অন্তঃস্থলে আমৃত্যু জাগরুক
থাকে। হতেই হবে, কারণ বেহেস্তে সূপের ছড়াছড়ি হলেও সে-
রাত্রে আমি যে সুখ ও তৃপ্তি লাভ করেছিলাম তার চেয়ে বেশী কিছু
সেখানে যে নেই হল। করে আমি বলতে পারি
3
আমার মনময়ূরী, আমার কলিজা রূপসীটি এক সময় চোখ
মেলে তাকাল। আমি পাশে বসে বুভুক্ষুর মত তার যৌবনভরা
নগ্নপ্রায় দেহটিকে নিরীক্ষণ করছি বুঝতে পেরে অকস্মাৎ তার মধ্যে
লাঞ্চশরম ভর কর। রাত্রে স্বেচ্ছায় নিজেকে সঙ্গ দিয়েছিল সেই
দিনের আলোয় যেন লাজে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। অতর্কিতে হাত
= দুটোকে নিজের বুকের ওপর তুলে নিয়ে যন্ত্রচালিতের মত
কাপড়টিকে কেমরে জড়িয়ে নিল।
5
$1
রূপসী নিজেকে একটু সামলে নেওয়ার পর আমি তার দিকে
দশটি সোনার মোহর বাড়িয়ে দিলাম। সে ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে বলল


—'মেহবুবা আমার, মোহর নিয়ে আমি কি করব? তুমি যেমন
আমার যৌবনসুধা পান করে তৃপ্তি লাভ করেছ তেমনি তোমার ওই
সুঠাম দেহ আমাকে কম তৃপ্তি দেয় নি। এ সুখ যে পরস্পরের
দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমেই একমাত্র পাওয়া সম্ভব! তুচ্ছ মোহরের
প্রশ্ন তো এর মধ্যে আসতে পারে না। তুমি আমার কলিজার সমান
বুঝতে পারো সং
এবার দরজার দিকে এগিয়ে গেল আমার মেহবুবা। আমিও
দু'পা এগোলাম। সে আমার মাথার দু'পাশে হাত রেখে আমার
মুখটিকে নিজের মুখের কাছে নিয়ে গেল। চুম্বন করল! আলভো
করে দুগালে হাত বুলিয়ে সোহাগ করল প্রাণভরে। তারপর আমার
দু'কাঁধে তার হাত দুটোকে রেখে সুরেলা কণ্ঠে উচ্চারণ করল –
'আমার মেহবুব, আমার দিলকা কলিজা তিনদিন পর আবার
আমাদের দেখা হবে, দৈহিক মিলন ঘটবে।' বাটুয়া থেকে কয়েকটি
দিনার বের করে আমার হাতে গুড়ে দিতে গিয়ে বল- - ‘মেহবুব
আমার, একটি কথা বলছি, আমায় ভুল বুঝে অংমাকে কষ্ট দিও না
যেন। আগামী দিনের যাবতীয় খরচ আমি করব।' এবার সে বটুয়া
থেকে কয়েকটি দিনার বের করে আমার হাতে জোর করে গুঁড়ে
দিয়ে বল— ‘এগুলো তোমার কাছে রেখে দাও মেহবুব। যা কিছু
দরকার মনে করবে, কিনে রেখো।
আমি তার কথায় প্রতিবাদ করে অসন্তোষ উৎপাদন করতে
উৎসাহী হলাম না। দিনার ক'টি হাত পেতে নিতে গিয়ে বললাম
‘তা-ই হবে মেহবুবা।'
সে ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমিভরা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে ধর
থেকে বেরিয়ে গেল।
সে বিদায় নেওয়ার পর এক একটি দিন যেন আমার কাছে
এক-একটি বছরে পরিণত হ'ল। আমার বুকের ভেতরটি যেন ফাঁকা
হয়ে গেছে। যাবার সময় যেন গোপনে আমার কলিজাটি চুরি করে
নিয়ে গেছে।
চার-চারটি দিন যে আমি কিভাবে অন্তহীন হাহাকার ও
হাহুতাশের মধ্যে কাটিয়েছিলাম তা বর্ণনা করার মত ভাষা আমার
চতুর্থ সন্ধ্যার কিছু আগে নিজেকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করে
আমার প্রাণ-প্রেয়সী আমার বারান্দায় হাজির হ’ল। বারান্দায় পা
দিয়েই সে বিদ্যুৎগতিতে গায়ের ওড়নাটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার
কামাতুর মনের তাড়নায় সে জ্বলে পুড়ে ষ্টীক হচ্ছে। তাঁর
মন্মোহিনী রূপের আগুন আমার গায়েও তারই মত জ্বালা ধরিয়ে
দিল। আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। তাকে এক ঝটকায়
কোলে তুলে নিলাম। ক্ষুধাতুর নেকড়ের মত একলাক্ষে তাকে নিয়ে
ঘরে ঢুকলাম। শুইয়ে দিলাম পালঙ্কের ওপর। সে আমার কণ্ঠলগ্ন


অবস্থাতেই আমার ঠোঁট দুটোকে কামজ্বালায় কামড়ে ধরল।
তারপর সারারাত্রি আমরা যে কিভাবে কাটিয়েছি তার একমাত্র
সাক্ষী ওই উৎপীড়িত পালঙ্কটি। তার যদি ভাষা প্রকাশের উপায়
থাকত তবে যথার্থ বর্ণনা দিতে পারত। আর আমি? অসম্ভব।
উন্মত্তপ্রায় অবস্থায় আমরা যে কিভাবে সারাটি রাত্রি নির্মম অবস্থায়
কাটিয়েছিলাম তার বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে বাস্তবিকই
সাধ্যাতীত। পুব-আকাশে রক্তিম ছোপ দেখা দিলে সে আমার কাছ
থেকে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় নিতে বাধ্য হ'ল। আমার
জীবনের দ্বিতীয় সহবাসরাত্রি কাটিয়ে সে বিদায় নিল। যাবার সময়
সে বিদায়-চুম্বন সেরে বলে গেল *মেহবুব আমার, চারদিনের
দিন সন্ধ্যায় আবার আমি তোমার সঙ্গসুখ লাভের প্রত্যাশা নিয় এসে
হাজির হ’ব।'
সত্যি এবারও চুতুর্থদিন সন্ধ্যার আগে সে আমার গরীবখানায়
হাজির হ'ল। মনমৌজী সাজে সে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে
দেখলাম। সামান্য কিছু খানাপিনা সেরেই আমি তাকে জাপ্টে ধরে
পালঙ্কের ওপর শুইয়ে নিলাম। তার চোখের তারার ভাষায় সে
আমাকে বুঝিয়ে দিল তোমার যৌবনের সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে
ছিঁড়েফুঁড়ে খাও। সম্ভোগের মধ্য দিয়ে আমাকে একেবারে শেষ
করে দাও মেহবুব। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইলাম।
উভয়ের নগ্নদেহ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। তার মন আকুল
হ’ল কাছে আসার, আরও কাছে আসার জন্য। কিন্তু আমি যে তাকে
সজোরে বুকে চেপে ধরে একেবারে আমার সঙ্গে লেপ্টে নিয়েছি।
আর কি করে সম্ভব?
সকাল হল। বিদায় মুহূর্তে সে আমার কাঁধে তার হাত দুটো
রেখে প্রশ্ন করল ‘মেহবুব আমার, সত্যি করে বল দেখি, তিন
দিন আমাকে সম্ভোগ করে তোমার কেমন লাগল?'
— হঠাৎ তোমার মুখে এ প্রশ্ন কেন মেহবুবা? তোমাকে কাছে
পাওয়ার পর আমার কাছে বেহেস্তের সুখও তুচ্ছ, বোধ হচ্ছে।



আমার যৌবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি তোমার যৌবনের
জোয়ারলাগা দেহভোগের মাধ্যমে! তোমাকে ছাড়া বাঁচার কথা।
আমি যে কল্পনাও করতে পারিনি। তোমার চেয়ে রূপসী পৃথিবীতে
অন্য কেউ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।'
সে ঠোঁট টিপে হেসে বল্ল আমার চেয়ে সুন্দরী দেখনি?
সামনের দিন দেখতে পাবে। তাকে দেখলে তোমার চোখ দুটো
ঝলসে যাবে।'
কথা বলতে বলতে আমার হাতে কুড়িটি মেহর দিয়ে বল
-- ‘আজ থেকে চতুর্থদিন আবার আমার দেখা পাবে। আর একটি
কথা, নতুন যে মানুষকে নিয়ে আসব তার আপ্যায়নের ত্রুটি হয়
না যেন।
সে এবারও কথা রেখেছে। চতুর্থদি স্ক্যার আগে সে আমার
বরজায় হাজির হ’৫ সালে একটি লেড়কি বয়স তার চেয়ে কম।
সে ঠিকই বলেছিল। সত্যি এক অপরূপ কে আমার সামনে এনে
দাঁড় করিয়েছে। বেহেস্তের পরীদের তৈরীর পর অবশিষ্ট
সৌন্দর্যটুকু নিয়ে এসে যেন এর গায়ে লেপে দেওয়া হয়েছে।
আমি সরাবের গ্লাসটি যাপি করে ঠোঁট থেকে নামলাম।
আমার মেহবুবা আমার দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে বলে উঠল
"কি মিলে মোর জন্য এমন রূপসীকে নিয়ে এলাম। একটু
সোহাগটে হাগ কর একে! এমন রূপ যৌবনের একত্র সমাবেশ
ঘটেছে এর দেছে, মনে দোলা লাগছেনা? একটু অধটু চেখে দেখ,
মালুম হবে।'
-
আমি যে এমন বোকার হদ্দ তা আগে জানতাম না। তার কথা
শেষ হতে না হতেই বলে উঠলাম – 'তা তুমি যদি নেহাৎই বল
তবে একবারটি রসাস্বাদন করে দেখতে পারি।'
— ১৯ৎকার। পুরুষ মানুষের ১৩ কথাই বটে। আজ রাত্রে
একে সর্ভোগ করে অধিকতর সুখ লাভ কর। এতে আমার আনন্দই
আমার মেহবুবা মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ঙ্ক। আর
আমি নবাগতা রূপসীকে নিয়ে পালঙ্কের ওপরে শুলাম। আমি
বিছানায় শুয়েই উদ্ভিন্ন যৌবনা নতুন মেয়েটিকে সম্ভোগের অন্য
বাস্ত হয়ে পড়লাম। হব না-ই বা কেন? তাকে প্রথম দর্শনেই আমার
রক্তে যে মাতম লেগে গেছে। বুকের ভেতরে কলিজাটি শুরু করে
নিয়েছে রীতিমত নাচন কোদন। আর তারই অভ্যুৎ কামন! অংমার
জাল-বুদ্ধি ও বিবেক-চৈতন্যকে নির্মূল করে দিয়েছে। সে মেঝেতে
শুয়ে ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে পড়ে রইল। আর আমি
পালঞ্চের ওপরে নবাগতা ফ্লপগ্রীকে নিয়ে হিংস্র নেকড়ের মত
সম্ভোগে মেতে ওঠলন। তার ষোল বছরের দেহটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে
খাওয়ার জন্য উন্মাদের মত আচরণ করতে লাগলাম। কতক্ষণ ধরে


Iা
র এবং কিভাবে আমি কামতৃষ্ণা নিবৃত্ত করেছিলাম সবকিছু আমার
পরে আর মনে পড়ে নি। কতক্ষণ পরে ক্লান্তদেহে ঘুমের কোলে
ঢলে পড়েছিলাম তা-ও বলতে পারব না।
সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন দেখি আমার বাঁ-হাতটি
রক্তে জবজব করছে। দেখামাত্রই আমার মনে হয়েছে বুঝি বা
ঘুমের ঘোরে খোয়াব দেখছি। যখন আমার ভেজা বালিশটি ঘাড়ের
কাছে চপচপ করতে লাগল তখন আমার দ্বিধা কেটে গেল। আমি
=ল যেন অতর্কিতে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। এ-তো খোয়াব নয়, সম্পূর্ণ
সত্য। সম্ভোগক্লান্ত মেয়েটিকে জানাবার জন্য তার মাথা ধরে ব্যস্ত
হাতে সজোরে নাড়া দিতেই আমার শীররের সব ক’টি স্নায়ু
একসঙ্গে ঝনঝনিয়ে উঠল। তার ছিন্ন মুণ্ডুটি বালিশ থেকে গড়িয়ে
■ বিছানায় পড়ে গেল। এমন এক পৈশাচিক দৃশ্যের মুখোমুখি হতে
হবে খোয়াবের মধ্যেও কোনদিন ভাবতেও পারি নি। মাথা ঝিম্‌ঝিম্
করছে, শরীর হিম হয়ে আসছে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল
- ‘হায়
আল্লাহ! এখন আমি করি কি?”
d
-
=
B
?
আমি উন্মাদের মত পালঙ্কের ওপর থেকে নিচের দিকে উঁকি
■ দিলাম। বড়-লেড়কিটির বিছানা শূন্য। ঘরের দরজা খোলা,
ভেজানো। উদ্ভ্রান্তের মত এক লাফে পালঙ্ক থেকে নামলাম।
দরজা খুলে বাইরে বেরোলাম। না, সে উধাও। কোথাও সে নেই।
■ বাইরে যাবার দরজার ছিটকিনি খোলা। দরজা ভেজানো।
যে উপযাচক হয়ে পর পর তিন দিন সম্ভোগ সুখে আমার দেহ-
মনকে তৃপ্তি দিয়েছিল সে-ই আজ আমার কলিজাটিকে টুকরো
টুকরো করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমি এখন করি কি? পালঙ্কের
ওপর পড়ে থাকা যুবতীর লাশটিকে কি করে সামাল দেব। শরীর
অবশ হয়ে পড়তে লাগল। লোক জানাজানি হয়ে গেলে প্রথমে
আমাকে হাতকড়া পরিয়ে সাদর অভ্যর্থনাসহ গারদে নিয়ে ভরবে


কী উটকো বিপদ ঘাড়ে চাপল। সবই নসীবের ফের। নইলে
এমনটি হবে কেন? মৃতার সার্কিন তো দূরের কথা, এম্ল কি নাম
পর্যন্ত আমার জানা নেই। কোতোয়ালের কাছে কি যে জবাবদিহি
করব তা ভেবেই অ'মি পৌরো হয়ে গেলাম। আমার মাথার চট্ট
করে একটি ফপি খেলে গেল! এক দৌড়ে একটি খস্তা গ্রন্থে
উন্মাদের মত ঘরের মেঝেতে গর্ত খুঁড়তে লাগলাম তারপর
আপদটির লাশ, তার কাপড়চোপড়, বালিশের ওয়াড় ও বিছানার
চাদর প্রভৃতি যা কিছুতে রক্তের ছোপ লেগেছিল সবই গর্তে ঢুকিয়ে
মাটিচাপা দিয়ে দিলাম।
তারপর নিজে সাফসুতরা হয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা
আমি জরুরী কাজে বাইরে যাচ্ছি।
করলাম। তাকে বलग
কাজ মিটলেই ফিরে আসব।' এক বছরের ভাড়া আগাম মিটিয়ে
দিলাম। আমার কাজের স্বপক্ষে যুক্তি ছিল, আমি ঘর ছেড়ে দিলে
অন্য কেউ ঘরটি ভাড়া করবে। তখনই আমার কুকর্মের কথা ফাঁস
হয়ে যাবে। এতে পুরো একটি বছরের জন্য তো অন্ততঃ নিশ্চিন্ত
হওয়া ঢোকা।
কায়রে পৌঁছেই আমার চাচাজ়ীদের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে
গেল। আমাকে দেখেই তাঁরা উল্লসিত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
কায়রে; পৌঁছেতেই আমার পকেট ফাঁকা হয়ে গেল। চাচারীরাই
আমার সার্বিক দায়িত্ব নিলেন
কায়রোতে কিছুদিন থাকার পরই চাচাজীরা কাজকাম মিটিয়ে
স্বদেশে ফেরার উদ্যোগ করল। আমি আরও কিছুদিন থেকে
কায়রো ও তার পর্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছা
প্রকাশ করলাম। তারা আমার পকেটে দিনারের গোছা গড়ে দিয়ে
স্বদেেেশর অভিমুখে যাত্রা করল.
আমি পর পর তিন বছর দামাস্কাসের বাড়িওয়ালাকে বাড়িভাড়া
মিটিয়ে দিলাম।
তিন তিনটি বছর পেরিয়ে যাবার পর ভাবলাম ইতিমধ্যে নির্ঘাৎ
ব্যাপারটি চাপা পড়ে গেছে। সবাই ভুলে গেছে। এবার দামাস্কাসে
গিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করলাম। প্রথমেই শোবার ঘরে
গেলাম। ঘরময় ধুলো ছড়ানো রয়েছে দেখলাম । কিন্তু ঘরে যা কিছু
ছিল সবই জায়গামত ঠিকঠাকই রয়েছে। বিছানাটি সামান্য উণ্টাতেই
আমার সর্বাঙ্গে অবাঞ্ছিত শিহরণ অনুভব করলাম ! একটি জড়োয়া
হাঁসুলী। সে রূপসীর গলায় দেখেছিলাম বটে। শোয়ার পূর্বমুহূর্তে
হয়তো গলা থেকে খুলে রেখেছিল।
কায়রোতে তিন বছর কাটাতে গিয়ে চাচাদের দিয়ে যাওয়া দিনার
প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল। এ অবস্থায় এতখানি সোনা হাতে পেলে মন
| তো চাঙা হয়ে উঠবেই। ভুলেও কি তখন ভাবতে পেরেছিলাম সবই
ডাইনীর কারসাজি। হারটি জোব্বার জেবে ঢুকিয়ে দিলাম। ধরে



তালা বন্ধ করে বাজারে গেলাম। আজই বেচে না দিলে নতুনত্তর
ফোন বিপদ এসে ঘাড়ে চাপতে পারে।
আমি এক জহুরীকে হারটি দিলাম। সে উল্টেপাল্টে দেখল।
তারপর আমাকে বসিয়ে রেখে মহাজনের ঘরে গেল। একটু খাদে
ঘুরে এসে বল—'হারগাছা নকল সোনা আর ঝুটো মুক্তোর তৈরি।
যদি আনল হ'ত এক হাজার দিনার দাম পেতেন। কিন্তু বর্তমানে এক
হাজার দিরহাম বড়জোর এর দাম পেতে পারেন।'
আমি তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। বললাম—'আমার একটু
তাড়া আছে। মেহেরবানি করে তাড়াতাড়ি দামটা মিটিয়ে দিন।'
বিস্সার এ পর্যন্ত বলার পর বেগম শাহরাজাদ দেখলেন,
বাইরের বাচিয়ে পাখির কিচির মিচির শুরু হয়ে গেছে। ভোরের
পূর্বাভাস। তিনি কিস্সা বন্ধ করছেন।
আঠাশতম রজনী
রাত্রি একটু গভীর হলে বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে এগেন।
বেগম শাহাজাদ কিত্সা শুরু করতে গিয়ে বললেন—'জাঁহাপনা,
সে-ইহুদী হেকিম তার কিস্সা বলে চলেছে—“আমি ব্যস্ততা প্রকাশ
করায় জহুরীর সন্দেহ হ'ল। সে ভাবল, হারগাছা চোরাই মাল না
হয়েই যায় না। হয় কারো গল্প বা সিম্মুখ থেকে ঝেঁপেছে নয়তো
কারো হারিয়ে যাওয়া মাল কুড়িয়ে পেয়েছে।
জহরী আমাকে মুখে কিছুই বল না। আমাকে আগের মতই
বসিয়ে রেখে আবার মহাজনের ঘরে যাবার নাম করে বেরিয়ে গেল।
একটু বাদেই ইয়া দশাসই চেহারার এক সিপাহী এসে কোন
কথা না বলে আমার হাতে কড়া পরিয়ে দিল। টেনে হিঁচড়ে
কোতোয়ালের কাছে নিয়ে গেল।
কোতোয়ালের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি কাঁপা কাঁপা
পলায় কোনরকমে উচ্চারণ কয়লাম—'হুজুর এ হারপাছা আমি এক
মেয়েকে মহব্বতের স্মারক হিসেবে উপহার দিয়েছিস্লাম। নসীবে
বেশী দিন সে টিকল না। দুনিয়া ছেড়ে বেহেড়ে চলে গেল। তারপর
আমার হারগাছা আমার হাতেই ফিরে আসে।
--'কোন্ দোকান থেকে, কত দাম দিয়ে কিস্সছিলে, বল তো!’
——হুজুর, সে কথা আজ আর ঠিকঠাক স্মরণে নেই। তবে
হাজার দুই দিরহাম হয়ত নিয়েছিল। আর কায়রোর এক জহুরীর
কাছ থেকে কিনেছিলাম।'
আমার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই কোতোয়ালের হাতের
চাবুকটি আমার পিঠে বার কয়েক আছড়ে পড়ল। আমি কোমরভাঙ্গ
সাপের মত দেহটিকে যন্ত্রণায় বার বার মোচড় মারতে লাগলাম।
চাবুকের ঘা মারতে মারতে কোতোয়াল ফল—'গাঁজাখুরি গল্প
শোনাচ্ছ, তাই না। তোমার কেনা হারাহার দাম কত তা তোমারই
জানা নেই। এবার জানতে পারবে এর দাম কত। এখনও সময় আছে,



কোথেকে এটি কেঁপেছ, বল?' 'আবার চাবুকের ঘা পড়ল।
আমি যন্ত্রণকাতর দেহটিকে বার বার কেঁকড়াতে কোঁকড়াতে
কালো কালো স্বরে বল্‌লাম— 'বিশ্বাস করুন, আমি এটি চুরি করিনি।'
আবার চাবুক সক্রিয় হ’ল। পরপর কয়েকটি ঘা বসিয়ে দিয়ে
কোতোয়াল হাঁপাতে হাঁপাতে বল্‌লেন—'এত দামীহার তোর কাছে
এল কি করে হারামজাদা? এ তো রাজা, বাদশা আর উজিরের ঘরে
ছড়া থাকার কথা নয়।
চাবুত্রে যা খেয়ে খেয়ে আমার মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে
এল—এক মহাজনের গদি থেকে হারগাছা আমি চুরি করেছি।'
মধ্যে বলা ছাড়া সে মুহূর্তে আমার উপায় কিছু ছিল না
চুরির ব্যাপারটি স্বীকার করে নেয়ার কারণ হচ্ছে, চুরির দায়ে
বড় জোর আমার একটি অঙ্গ খোয়াতে হবে। কিন্তু হত্যার ব্যাপারটি
| ফাঁস হয়ে গেলে নির্থাৎ গর্দান যাবে। তখন প্রাগনগুই হবে আমার
! একমাত্র শক্তি।
কোতেয়ালের নির্দেশে সিপহীরা আমার ডান হাতটি কেটে
| ফেব্রুল। এমন একটি মক্তার এর বাতাসে ভর করে সারা শহরে
ছড়িয়ে পড়ল। বাড়িওয়াল| সঙ্ক জবাব দিলেন— তোমাকে নিয়ে
| নগর তোলপাড় হচ্ছে আমার বাড়ি থেকে মানে মানে কেটে পড়।
আজই অন্য কোথাও চলে যাও ভাই।'
আমার কাতর মিনতিতে বাড়িওয়ালা একটু নরম হলেন। বাড়ি
খেঁজার জন্য দিন কয়েক সময় দিলেন
কি করি, কোথায় যাই? কার কাছে গিয়ে আশ্রয় পাই কাটা
হাত নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়াও তো সম্ভব নয়। তামাম দুনিয়ার
লোক জানে, চুরি করলে ডান-হাক্ত কাটা যায়। আমি দুটো দিয়ে
পানির ধার’ মেমে এল। বানিয়ে কোন একটি কিস্সা দাঁড় করালে
কি মুলুকের কেউ বিশ্বাস করবে আমার কথা? অবশ্যই না:
কি যে করি ভেবে পেলাম না। আমার হাত কাটার ব্যাপারটি
রাষ্ট্র হয়ে গেছে। বাসা খুঁজতে বেরনোরও সমস্যা রয়েছে। আমাকে
কে-ই বা আশ্রয় দেবে! আল্লাহ্ র ওপর সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে
ঘরের কোপেই পড়ে রইলাম।
আমি তন্ময় হয়ে আমার নসীবের কথা ভেবে চলেছি। এমন
সময় অকস্মাৎ কাঁটামারা বুটের গম্ভীর আওয়াজে সচকিত হয়ে
তাকলাম। দেখলাম, আমার সামনে সেনাবিভাগের প্রধান দাঁড়িয়ে
রয়েছেন। সুবেদারের নির্দেশে আমাকে কর্মী করলেন।
হাতকড়া পরিয়ে সুবেদারের দরবারে আমাকে হাজির করা
হ’ল। একদল লোক সেখানে ভিড় করে অপেক্ষা করছে। কার জন্য?
হয়ত বা আমারই জন্য। তাদের ভিড়ে আমার বাড়িওয়ালা এবং সে
জব্বী দু'জনও রয়েছেন।
সুবেদার সাহেব গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন—'কোতোয়াল


তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে, তুমি নাকি এ-জহুরীর
দোকান থেকে হারছড়া চুরি করেছ? কিন্তু জহুরীর কথা তো সত্য
নয়। হারটি তো আমার মেজো লেড়কির। আমার বড় লেড়কির
সঙ্গে সে বেড়াবার নাম করে তিন বছর আগে এক বিকেলে ঘর
থেকে বেরিয়েছিল। সে-যাওয়াই তার অন্তিম যাওয়া। তারপর সে
আর ঘরে ফেরে নি। তুমি যদি সাচ বাৎ রল তবে আর তোমাকে
কোন শাস্তি দেব না, কথা দিচ্ছি। আজ হারছড়া ফিরে পেয়ে অনুমান
করছি সে আর দুনিয়ায় নেই।' কথা ক’টি বলেই সুবেদার আমার
হাতকড়া খুলে দিতে বলেন। আমি ধরেই নিলাম, মৃত্যু আমার
শিয়রে। কেউ-ই আমার জান রক্ষা করতে পারবে না।
সুবেদার অন্যান্য সবাইকে দরবারকক্ষ ছেড়ে চলে যেতে
বলেন। এত বড় একটি ঘরে কেবল আমরা দু'জন, আমি আর
সুবেদার রয়ে গেলাম। তিনি আমাকে নিচু গলায় বললেন—'বেটা
আমাকে ব্যাপারটি কি, বল তো? আমার বিশ্বাস, তোমার দ্বারা কোন
ন্যক্কারজনক কাজ করা সম্ভব নয়। তোমার চোখ-মুখ বলছে, তুমি
অভিজাত ঘরের ছেলে। আমি যদি তোমার রক্ষাকর্তা হয়ে পিছনে
দাঁড়াই তবে কেউ-ই তোমার গায়ে কাঁটার আঁচড়টি কাটতে পারবে
না। অতএব তুমি নির্ভয়ে যা কিছু ঘটনা, বলতে পার। সে-কাহিনী
যত মর্মান্তিকই হোক না কেন তুমি আমার কাছে ব্যক্ত কর।'
আমি শিশুর মত হাউমাউ করে কেঁদে ফেল্লাম। ডুকরে ডুকরে
কেঁদে বল্লাম—আপনি আমাকে শাস্তি দিন আর না-ই দিন আমি
সব কিছু আপনাকে খুলে বলবই। অন্ততঃ নিজের স্বার্থের তাগিদে



অঞ্চাকে স্প বলতে চাই। আমি চাই সব কিছু বলে নিজের বুক
থেকে পাথরের বোঝাট হাল্কা করতে।
আমি তিন বছর আগেকার সে ঘটনাটি বলতে শুরু ক্রলাম।
সবার আগে বল্লম প্রথম স্ক্লেকিটির কথা। আমার সঙ্গে তিন রাত্রি
বাস করে সে যা কিছু করেছিল, কিছুই গোপন করলাম না। তার
প≤ কারে এবং কেন দ্বিতীয় লেডকিটিকে এনেছিল তা-ও বল্লাম
আমাদের পালক্ষে শুতে দিয়ে নিরে ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে
ওয়েছিল তা-ও বাব দিলাম না। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে গভীর রাত্রে
ছোট লেড়কিটিকে হত্যা করে সে-বাড়ি থেকে চম্পট দিয়ে ছিল তা-
হয়ে বললাম।
সুবেদারের দু'আঁখিঁর কোল বেয়ে পার্টির ধার নেমে এল। তিনি
রুমাল দিয়ে মূখ মুছতে মুছতে বললেন—'বড় লেড়কিটিও আমারই
লেড়কি। কৈশোরে পা নিয়েই সে দ্রুত খারাপ হয়ে যেতে থাকে।
উচ্ছৃঙ্খলতার চূড়ান্ত বলতে পার। ঘরে কাউকে না বলে বহিরে রাত্রি
কাটাতে শুরু করে। মনা করলে পাত্তা দিত না। বহু শাসন করে,
কঠোর শাড়ি দিয়েও কিছুতেই তাকে বশে রাখা যায় নি। ম
চরিত্রবান ছেলেই হোক না কেন তাকে সে পাঁকে টেনে নামাতোই।
'ভাবলাম, শাদ-নিক' দিলে বুঝি তার চারিত্রিক দোষগুলি কেটে
যাবে কোন ফলই হ'ল না বরং বছর দুই যেতে না যেতেই তার
স্বামীটি সামান্য রোগভোগে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। কমিকালা
নির্বাপিত করার অপূর্ব সুযোগ এল তাঁর হাতে। মিশরের মেয়েদের
যা কিছু খারাপ স্বভাব সবই সে রপ্ত করে নিয়েছিল। এবার আমি
নিঃসন্দেহ হলাম। মিশর থেকে ফিরে এসে তোমার কাঁধেই ভয়
করেছিল। সে পর পর তিন রাত্রি ডোমার ধরে, তোমার সঙ্গে সহবাস
করেছে।
আমি ক্ষুব্ধ হলাম যখন দেখলাম সে তার মেজো বহিনকেও তার
পথে নামিয়েছে। আমি সর্বদা মেজো মেয়েটিকে সতর্কতার সঙ্গে
পাহারা দিতে লাগলাম। অসকে মিশরের লেড়কিদের মত উচ্ছৃঙ্খল
পেড়কি তামাম দুনিয়া চত্তর মেরে এলেও জন্য কোন দেশে দেখা
পাওয়া যাবে না। নিজের কামতৃষ্ণা নিবৃত্ত করতে প্রয়োজনে সে
নিজের লেড়কাকেও খুন করতে পারে।
আমার মেজো ডুেকির বয়স ছিল খুবই কম। উঠতি বয়স।
কামহবৃত্তি কি সবে সে বুঝতে শিখেছে। এ বয়সে মেয়েদের, বিশেষ
করে তাদের অভিভাবককে একটু চোখ-কন খুলে রাখতেই হয়।
কিন্তু আমার পক্ষে তে। অন্দরমহলে পড়ে থেকে গেড়কিসের
সামলানো সম্ভব নয়। তার ওপর বড় লেড়কির কায়দ।-কৌশলের
সঙ্গে আমি সত্যি পেরে উঠহিলাম না। তাই মেছো লেডকিটিকে
নিয়ে সে মাঝে-মধ্যেই অন্যত্র রাত্রিবাস করত।
'একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরতেই দেখি বড় লেড়কিটি


Fহাউমাউ করে মরাকান্না জুড়ে দিয়েছে। আমি হৃদার কারণ জিজ্ঞেস
করলে সে ডুকরে ডুকরে কেঁদে বল— আমি তাকে নিয়ে সন্ধ্যার
I বাজারে কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম। ভিড়ের মধ্যে কোথায়
যে সে হারিয়ে গেল কিছুতেই হদিস করতে পারলাম না।' আজ
A তোমার কথায় বুঝতে পারছি, সে তোমার সঙ্গেই সে-রাত্রি
কাটিয়েছিল।
আজ আমি পরিষ্কার বুঝতে পড়ছি, আমার মেজো লেড়কিটিকে
খুন করার ব্রুনাই বড় লেড়কিটি তাকে তোমার ওখানে নিয়ে
গিয়েছিল। আদতে তার রূপ-সৌন্দর্য তার বাহনজী সহ্য করতে
পারছিল না জ্বলন্ত ঈর্বার বশেই সে এ-কাডো প্রবৃত্ত হয়েছিল।'
E
1
সুব্বোর সাহেব এবার চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—'বেটা,
এখন বুঝতে পারছি, বি! অপরাধেই তোমাকে তান হাতটি খোয়াতে
হয়েছে। আমি তার জন্য অনুপ্ত। যা ঘটেছে তা তো আর ফিরে
পাওয়া যাবে না। তুমি নতুন করে জীবন
* কর।'
—'আপনার অনুতাপ জ্বালার কথা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু
এ রকম একটি কাটা হাত নিয়েও তো অসর পক্ষে নিজের মুলুকে
ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার কপ! লোকে বিশ্বাস করবে কেন?'
—“আমারও ইচ্ছে হয় তুমি এ-জায়গা ছেড়ে অন্যত্র যাও। বেটা,
আমার বিল পেড়কি, একটিং পেজকা নেই। আমার ছোট
1 লোককে শাদী করে এখানেই সংসার-জীবন যাপন কর, আমার
ইচ্ছা। সে সুন্দরী। সচরাচর এমন রূপ দেখা যায় না।'
--আপনার মর্জি অনুযায়ীই আমি চলব। তবে মুলুকে আমার
■■আব্বাজী নাকি বেহেস্তে গেছেন। অংমার প্রাপ্য বিষয়-সম্পত্তির
একটি বিহিত করতে চাই।'
-- চমৎকার। আক্রই জামি একজন উচ্চপদস্থ কর্মীকে সেখানে
■ পাঠাচ্ছি। তোমার যা কিছু প্রাপ্য বুঝে নিয়ে আসবে। এ নিয়ে তুমি
ভেবো না বেটা।'
আমি এবার সুবেদারের ছোট লেড়কিকে শাদী করে সংসার-
■ জীবন শুরু করলাম। বিবি আমার মনের মতই হয়েছে। আমাকে
নিজের কলিজার ১৩ই হাল করে।
ইঙ্গী হেকিম বলতে লাগল— জাঁহাপনা, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত
সে-ঘুবকের মুখের কিস্স। শুনতে লাগলাম। একমাত্র সুবেদারের
উপার, বুদ্ধিমত্তা ও ন্যায় বিচারের ফলেই সে বার আমি নিশ্চিত
হমের দুয়ার থেকে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।'
সুবেদার তাঁর জামাতার রোগ নিরাময়ের পর গুচুর দিনার
আমাকে উপহার দিলেন। প্রচুর অর্থের মালিক হয়ে গেলাম আমি।
শ দিয়ে দেশ দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। নানা মূলক ছুঁড়ে আমি
আপ্পার মুমুকে হাজির হলাম। তারপর শাদী করে. এখানেই
স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি


—জাঁহাপ্পা, কে বা কারা যে আমার বাড়ির সিঁড়িতে
কুঁজোটিকে ফেলে রেখে গিয়েছিল তার হদিস পাওয়া যায় নি।
চীনের সুলতান এবার মুচকি হেসে বললেন—'তোমার
ঈস্স্সাটি মদ জমাও নি হেকিম। তবে কুঁজোর্টির মৃত্যুর ঘটনার
| কাছে তোমার কি কোণঠাসা হয়ে পড়তে বাধ্য। আমি দৃঢ়
প্রতিজ্ঞ, তোমাদের কাউকেই ছেড়ে দেওয়া চলে না। মৃত্যু
তোমাদের অরিহার্ব।
ইহুদী হেলিমের কিসসা শেষ হলে সে-স্পর্কি এগিয়ে এল।
সুলতানকে লক্ষ্য করে বলে— 'জাঁহাপনা, সবার কিস্সাই তো
শুনলেন। আমার কথা কিছু শুনলে অনন্দিত হই।'
—'ঠিক আছে, শুনছি, তবে তোমার কিস্সা। যদি আমার মনে
হরে তবে তুমি মুক্তি পাবে।'
ভর্তি তার বিস্সা শুরু করল—'তাঁহাপনা, অদৃষ্টবিড়ম্বিত এ
কুঁজোর মৃত্যুর আগে আমি এক বাড়িতে প্রীতিভোজের আসরে
যোগদান করতে গিয়েছিলাম। সেখানে নবাবের বংসম্মানিত ব্যক্তির
সমাগম হয়েছিল। নিমন্ত্রিতরা সবাই এলে এক এক করে জড়ো
হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, গৃহকর্তাকেই দেখা যাচ্ছে না।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে এক সুদর্শন যুবককে নিয়ে তিনি নিমন্ত্রিতদের
কাছে এলেন। যুবকটি কেবল মূদনই নয় মূল্যবান পোশাকে
সজ্জিতও বটে। পোশাকের মধ্য দিয়ে পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, সে
বাগদাদের অধিবাসী!
যুবকটির দিকে চোখ পড়তেই আমার মনটা হঠাৎ বিষিয়ে
উঠল। দেখলাম, যুবকটির একটি পা খোঁড়া। হাসিখুশী মুখ নিয়ে
সে আমাদের কাছে এল বটে। কিন্তু আসরে সবার সঙ্গে বসার পরই
তাঁর মুখে কেমন এক অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠল। গৃহকর্তা
কবোধের স্বরে বলেন—“ধৈর্য ধরে যত্ন বেটা! কেন, এভাবে ে
কারে, আমি কি এখন কসুর করলাম, বলবে কি? না বল্‌লে, বুঝবো
কি করে। আমাকে বল, হায়েছে কি??
— এখানে নিমন্ত্রিত মেহমানদের মধ্যে এমন একজন রয়েছেন
ষাকের তামি নিদারূপ ঘৃণা করি। খোদাতালার নামে কসম খেয়ে
বলছি, একসারিতে বসে খানাপিনা করা তো দুরের কথা তার সঙ্গে
বসবো না পর্যন্ত। তাই আমি এ জায়গা ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক। আমি
তার নাম প্রকাশ করে আপনার আমন্ত্রিতদের কাউকে দুঃখ দিতে চাই
না জাঁহাপনা!'
—কিন্তু বেটা, তুমিও তো আমার নিমন্ত্রিত মেহমান।
তোমাকেও তো আমি চলে যেতে দিতে পারি না। তোমার গোস্সার
কারণ কি? কি জন্যই বা তোমাকে এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে
অনন্যোপায় হয়ে নিমন্ত্রিত ঘুবকটি নিমন্ত্রিত নাপিতের প্রতি


তর্জনী নির্দেশ করে বল — হুজুর, এর জন্যই আমাকে পা-টি
খোয়াতে হয়েছে। আর এরই জন্য আমাকে স্বদেশ চীন ত্যাগ করতে
হয়েছে। সে আমার জীবনে সাক্ষাৎ রাহরূপে কাজ করছে। কসম
থেয়েছি, জীবনে এর মুখ দেখব না কোনদিন। খোদাতাল্লার নামে
কসম খেয়েছি কি, জীবনে কোনদিন এর সঙ্গে এক সারিতে বসব
না। এক সারিতে বসে পানাহার করব না, কোন উৎসব অনুষ্ঠানেও
এর সঙ্গে যোগদান করব না। দেশান্তরি হয়েও একে এড়াতে পারছি
না। ছিনে জোঁকের মত যেন আমার সঙ্গে এ সেঁটে রয়েছে।
5
কথাটি শুনে নাপিত প্রতিবাদে মুখর হওয়া তো দূরের কথা,
মুখতুলে তাকাতে পর্যন্ত পারল না।
আমাদের বিশেষ অনুরোধে সে-যুবক আমাদের তার কিস্সা
শোনাতে গিয়ে বল—আমার আব্বাজী বাগদাদের এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ
সওদাগর ছিলেন। তিনি ছিলেন যথার্থই একজন অর্থের কুমীর। কিন্তু
তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন খুবই মিশুকে সদালাপী, ভদ্র ও বিনয়ী।
বিদ্যা-শিক্ষাতেও তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। আমি পাঠাভ্যাস সাঙ্গ
করার পর পরই আমার আব্বাজী দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে বেহেস্তে
চলে গেলেন। আমি তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির
মালিকানা লাভ করলাম।
অগাধ পৈত্রিক সম্পত্তি হাতে আসায় আমি আড়ম্বর-প্রিয় হয়ে
উঠলাম। খানাপিনা সাজসজ্জার বহর আমার বেড়ে গেল
মাত্রাতিরিক্ত। মোদ্দা কথা, বিলাস বহুল জীবনের মধ্যে আমি তলিয়ে
থাকলাম। তবে হ্যাঁ, কোন লেড়কির প্রতি আমার আকর্ষণ তো ছিলই
না, এমন কি তাদের ধারে কাছেও ঘেঁষতাম না।
একদিন আমি পথের ধারের বাড়ির রোয়াকে বসেছিলাম! তখন
বিকেল। সন্ধ্যের আগে আগে। হঠাৎ আমার সামনের বাড়ির
জানালায় এক রূপসী তন্বী যুবতীকে দেখতে পেলাম। রূপ আর
যৌবনের এমন অভাবনীয় মিলন সচরাচর দেখা যায় না। এক মুহূর্তে
আমার মন থেকে লেড়কিদের প্রতি বিতৃষ্ণা ভাবটি নিশ্চিহ্ন হয়ে
উবে গেল। তাকে দেখামাত্রই মহব্বতের ফাঁদে জড়িয়ে পড়লাম।
আমার মনময়ূরীটি কিন্তু আমার দিকে এক লহমার জন্য তাকিয়েই
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। একটু বাদেই জানালাটি বন্ধ করে চলে
গেল। আমার মনে তখন মহব্বতের নেশা চেপেছে। জানালাটির
দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই আমি রোয়াকে ঠায় বসে রইলাম। কিন্তু
জানালাটি আর খুলই না। অনন্যোপায় হয়ে আমি চাপা দীর্ঘশ্বাস
। ফেলে সে-বাড়ির রোয়াক থেকে উঠে নিজের বাড়ি ফিরে এলাম।
কিন্তু হায়! সে-রূপসীর কাছে আমার মন বাঁধা পড়ে গেল। স্বস্তি
হারিয়ে ফেল্লাম। তাকে যতই মন থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করি
মন ততই তার দিকেই ধেয়ে যায়। এ-ত মহামুশকিলে পড়া গেল।
; পরিস্থিতি এক সময় এমন ভয়াবহ রূপ নিল যে, তাকে না পেলে


যেন আমার জীন্দেগীই বরবাদ হয়ে যাবে। আমার কাম কাজ সব
শিকেয় উঠল।
তারপর থেকে প্রায়ই সে-রোয়াকে গিয়ে জানালাটির দিকে
তাকিয়ে তীর্থের কাকের মত বসে থাকি। মনে মনে হাপিত্যেশ করি
তাকে একবারটি চোখে দেখার জন্য।
খুব
বল
বা
একদিন দেখলাম, নোকর-নফরসহ সুলতানের কাজী এক থা
খচ্চরের পিঠে চেপে সে বাড়িটির দরজায় এলেন। দরজাটি খুলে পা
গেল। তারা সবাই বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। বুঝতে পারলাম এটি ফি
কাজীর বাড়ি। আবার দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। চাপা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে উঠে পড়লাম। বুকভরা হাহাকার আর হাহুতাশ নিয়ে
বাড়ি ফিরলাম।
রূপসী যুবতীটির চিন্তায় চিন্তায় আমার তবিয়ত খারাপ হয়ে
গেল। বিছানা আশ্রয় করলাম। নোকররা হেকিম ডাকতে চাইল। বাধা
দিলাম। মহব্বতের বিমারি। হেকিম তার ইলাজ করতে পারবে কেন!
আমার বিমারির কথা শুনে আত্মীয়-বন্ধু ও প্রতিবেশীরা এসে
আমাকে দেখে যায়। নানারকম উপদেশ দিতেও কসুর করে না।
একদিন এক অপরিচিতা বুড়ি আমার ঘরে এল। আমরা দু'জন
ছাড়া তৃতীয় কোন আদমি সে-ঘরে ছিল না। বুড়ি প্রায় ফিসফিসিয়ে
বল্ল —'বেটা, তোমার কি হয়েছে আমাকে বল তো শুনি। যদি
তোমার জন্য কিছু করতে পারি, কোশিসের কসুর করব না।'
আমি কোনরকম দ্বিধা না করে বুড়িকে সবকিছু খুলে বল্লাম।
তাকে না পেলে আমার জিন্দেগী বরবাদ হয়ে যাবে এমন কথাও তা
বলতে কসুর করলাম না।



সবকিছু শুনে বুড়ি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বল—‘বেটা, সবই
ভো বুঝলাম। কিন্তু সে সুলতানের কাজীর লেড়কি। কাজী সাহেব
খুবই বদমেজাজের লোক।' মুহূর্তকাল ডেলে বুড়িটি এবার
বল—'তবে ভরসা হচ্ছে, কাজী আর ওঁর বোঁট একই বাড়িতে
বাস করলেও তাদের উভয়ের মহল ভিন্ন এক তলায় কাজী নি
থাকেন। আর তাঁর লেড়কি থাকে দোতলায়। নোকর-চক্রানী কড়া
শহারায় তাকে রাখে: শোচা মাৎ পেটা, আমি একটি না একটি
ফিকির বের করতে পারবই।'
আমি বুড়ির কাছ থেকে প্রশ্বাস পেয়ে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠলাম।
পরদিন বুড়ি আবার আমার বাড়ি জল। ভাবলাম, নিশ্চয়ই সে
কোন সুখবর নিয়ে এনেছে। কিন্তু আমাকে হতাশ করে দিয়ে বুড়ি
বল—'বেটা, আমি হেরে গেলাম। পারলাম না। লেডার্কটির কাছে
। প্রস্তাব দিতেই আমাকে গালাগালি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিল।
আমি নাকি তাকে কুপথে নামার জন্য উৎসাহিত করছি। এমন কি
শাস্তির ভয়-ডরও আমাকে কম দেখায় নি 'বেটা, আমি আশাহত
হয়ে হালছাড়ার পাত্রী নই। যে করেই হোক তাকে আমি পথে
ভেড়াবেহি।'
বুড়ির কথায় আমি বাণহিন্ধু চিড়িয়ার মত ছটফট করতে
লাগলাম। আবার বিছানায় আশ্রয় নিলাম। খানাপ্পিা পর্যন্ত ছেড়ে
দিলাম।
কয়েকদিন পর আবার আমার হিতকারিণী বুড়ির দেখা পেলাম।
তার মুখে হাসি। বুকে আনন্দের জোয়ার। ঠোঁটের কোণে হাসির
রেখাটুকু অব্যাহত রেখেই বাতা— 'বেটা, কাজ অনেকখানিই
এগিয়েছে। মিঠাই খাওয়াতে হবে কিন্তু।'
—মিঠাই যাবে এ আর বড় কথা কি গো। কিন্তু কিভাবে,
| কতখানিই বা কাজ হাসিল করলে, শুনি?'
—— লেড়কিটিকে বল্লাম-তোমার জন্য একটি তাজা লেড়কা
আহা মরতে বসেছে। সে হয়ত অর কঁচবেও না বেশীদিন।'
আমার কথায় লেড়কিটি তো মূৰ্চ্ছা যাওয়ার জোগাড়।
কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বল্ল--'সে
কী কথা! আমার জন্য একজনের জান যেতে বসেছে। আমি তার
কোন পকা ধানে মই দিয়েছি বলতে পার?
--তুমি অবশ্য জেনেশুনে কিছু কর নি। তোমার দিল পাগল
করা রূপ-যৌবন তার কলিজাটিকে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে।
আর তার সে বিমারি সরানোর ক্ষমতা হেকিমের দাওয়হিয়ের নেই।
একমাত্র তুমিই তার স্বস্তি ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে পার বেটি।'
আমার দাওয়াহয়ে কাজ হয়েছে দেখলাম। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি
মেলে আমার দিকে তাকিয়ে বল্ল – তোমার সে লেড়কাটি কে?
কোথায় থাকে? আমি কি কোনদিন দেখেছি তাকে?'


——বেটি, সে আমার পেটের লেড়কা না হলেও ভার চেয়েও
যাৰু কিছু! এই তো ক'দিন আগেই সে তোমাকে সামনের এই বাড়ির
থেকে দেখেছে। বাস, তোমার মহব্বতে মকে গেছে:
তারপর থেকেই সে তোমার গুবসুরৎ রূপ দেখে পাগল হয়ে গেছে!
নিয়েছে। এখন তার জ্ঞান নিয়ে টানাটানি। তোমার পিয়ার-
মহব্বত-সোহাগই একমাত্র তার ভান রক্ষা করতে পারে।'
ফ্যাকাসে-বিবর্ণ মুখে লেড়কিটি বলল——সে কী, আমার জন্য
ক্লান্ত :স জান কবুরু করেছে!
——সবই তো বল্লাম বোঁট। এখন ভূমি রা ভাল মনে কর তা
ই করবে তোমার মতামত নিয়ে গিয়ে তার কাছে পেশ করব।
-তুমি যত শীঘ্র পার গিয়ে তাকে জানাও আমি তার জন্য
| দুহবেদনা ভোগ করছি। কাল নামান্ডের পর তার পথ চেয়ে আমি
বসে থাকব। তাকে বলবে, আমার সঙ্গে মোলাকাৎ করতে। তবে এ-
ও বলো, আব্বাজান নামাজ পড়ে আসার আগেই তাকে বিদায় নিতে
বুড়ির কর্মতৎপরতা ও সাফল্যের কথা শুনে মোহরের থলি
থেকে কয়েকটি দিনার তার হাতে গুঁজে দিলাম।
অমার দিলটি তখন ঘূর্ণীতে টগবগ করতে থাকে। ক'দিন
| নাওয়া-খাওয়া নেই। চোখে-মুখে কালির ছোপ, মুখ ভর্তি দড়ি। এক
নোকরকে বল্লাম, একটি দাপ্তি ডেকে আনতে। সে রাস্তার মোড়
থেকে এক নাপিতকে ধরে নিয়ে এল। এ-ই সে নাপিত জাঁহাপনা।
আমার জীবনের সাক্ষাৎ অভিশপ। অমার রাছ, দুষ্টুগ্রহ।
প্রথম দেখা হওয়া মাত্রই সে কুর্ণিশ করে বল্ল –‘খোদাতালার
লেয়ায় আপনার সব দুঃখ-যন্ত্রণা কেটে যাবে। আসলে নিরবচ্ছিন্ন
সুখ। আগর খুশীতে আপনার দিল্ল ডগমগিয়ে উঠবে। এমন এক
দাওয়াই আমার জানা আছে যাতে আপনি হাত শাস্তি-সুখ ফিরে
পাবেন।'
আমি মুচকি হেসে বল্লাম-'জপনি আমার চুল ছেঁটে লন্ড।
তোমার দাওয়াইয়ের কথা পরে না হয় এক সময় শুনব।' এবার সে
ব্যক্তৃতার লক্ষণ প্রকাশ করল। তার যন্ত্রপাতির কাঠের বাক্সের ভেতর
থেকে লাল শালুতে মোড়া একটি পোটলা বের করল। আমি ধরেই
নিলাম জুর, কাচি প্রভৃতি বের করছে। কিন্তু আমি অবাক না হয়ে
পরলাম না। পোটলার ভেতর থেকে সে বের করল একটি
জ্যোতিষী কিতাব। আর একটি আশি, সান্ড মুখওয়ালা আশি বিচিত্র
তার গড়ন, সে রৌদ্রে গেল। আয়নাটি থেকে সূর্যরশ্মিঃ কিতাবটির
পাতার গায়ে প্রতিফলিত করে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরগুলো পড়তে লেগে
গেল। এক সময় আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল—'হুজুর, অজ
হিজরী সাত শ' তেষট্টি সন আর দশই শকর শুক্রবার। খোদা-
ভাল্লাহ-র কাছে আজ যে, যা চাইবে তা-ই পারে। আজ বৃহস্পতি


আর মঙ্গল একই ঘরে অবস্থান করছে। এখন ঘড়িতে সাতটা ছয়
মিনিট। এ-সময়ে ক্ষৌরকর্মের পক্ষে-প্রকৃষ্ট সময় হুজুর। আর এরই
ফলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে পারে। শোনলাম, আজ আপনি মেহবুবার
সঙ্গে মোলাকাত করতে যাচ্ছেন। আপনাকে জানিয়ে দেওয়া আমার
কর্তব্য বলেই জ্ঞান করছি। আপনার এ প্রয়াসের ফল খুবই ভাল
হতে পারে, আবার মন্দ হওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। আপনার
মেহবুবার সঙ্গে মোলাকাতের পরিণাম কি হবে তা আমি এ-কিতাব
দেখে, গণনার মাধ্যমে নখদর্পণে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার
ওস্তাদের নির্দেশ, যেন কিছু না বলি। এতে আমার লব্ধ বিদ্যার
দাম্ভিকতাই প্রকাশ পাবে। তাই আমি জানলেও আপনাকে কিছুই
বলতে আগ্রহী নই।'
আমি বিরক্তি প্রকাশ করলাম——খুব হয়েছে! তোমার বকবকানি
থামাও বাপু। আমার খুবই তাড়া রয়েছে। যদি পার খুব তাড়াতাড়ি
চুল ছেঁটে আমাকে অব্যাহতি দাও!'
—“ঠিক আছে। হুজুর যা বলবেন আমি তা-ই করব। চুল ছাঁটাই
আমার পেশা। এ ছাড়া হেকিমি বিদ্যাও আমার ভালই জানা আছে।
বহুত আদমির দুরারোগ্য বিমারি আমি সারিয়ে দিয়েছি। আবার
আপনাকে আমি এমন কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে দেব যার ফল হাতে
নাতে পেয়ে যাবেন। আমি অর্থ চাই না। কোন বদমতলবও আমার
নেই। আপনার হিত সাধিত হোক এটাই আমার আন্তরিক ইচ্ছা।
আপনি চাইলে আমি আপনার কাছে সারা বছর রোজ এসে আপনার
কর্তব্য সম্বন্ধে বিধান দিয়ে যেতে রাজি আছি। এর জন্য আমাকে
পারিশ্রমিক কিছুই দিতে হবে না। আবার ক্ষৌরকর্ম করে দিতেও
রাজি আছি। এর জন্যও আমি কোন অর্থ প্রত্যাশা করি না। এবার
বসুন, যার জন্য আজ ডেকেছেন। ক্ষৌরকর্ম করে দিচ্ছি।'
আমি উন্মাদের মত চেঁচিয়ে উঠলাম—'তুমি দেখছি আমাকে


পাগল না করে ছাড়বে না হে। তোমার মতফবখানা কি সত্যি করে
বল তো? আমার মন চাইছে, ওই ক্ষুরটি দিয়ে তোমার বড় থেকে
মুগুড়ি নামিয়ে নেই।
কিস্সার ও পর্যন্ত ব’লে বেগম শাহরাজান চুপ করলেন। পূর্ব
আকাশে রক্তিম ছোপ উকি দিতে লাগল।
ঊনত্রিশতম রজনী
বাদশাহ শারিয়ার অন্দরমহলে এলেন।
বেগম শাহরাজাদ তাঁর কিস্স শুরু করতে গিয়ে
বললেন—জাঁহাপনা, যুবক হেঁৗড়াটি যখন নাপিতের ঘ্যান ঘ্যানানিতে
অধের্য হয়ে বঙ্গল—ক্ষুর দিয়ে নাপিওটির গল্পটি নামিয়ে দেয়ার
ইচ্ছা প্রকাশ করল তখন নাপিতটি মুচকি হেসে বল্ল-হুজুর
আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার বিশ্বাস আমি মিছেই বন্ডবল কমি,
অলতে কিন্তু আদৌ তনয়। তামার ছ'টি ছোট ভহিয়া আছে। তাদের
সবার কীর্তির কথা বলছি। আমার বড় ভাইয়ার নাম অল বাহুবুক :
এর অর্থ পূর্ণ কলসি থেকে জল ঢালার সময় যে অদ্ভুত এক শপের
উদ্ভব হয়।
আমার দ্বিতীয় ভাইয়ার নাম অঙ্গাদ্দার। এর অর্থ উটের
ঈস্বরা
শব্দ
আর তৃতীয়জনের নাম হল-বাক্ব। এর দুর্থ গেরগের ডাক।
চতুর্থ ভাইয়ার নাম অল-কুরু-ধুসবান। এর অর্থ কলসী ঠুকলে
যে হাওয়াদ্রের উদ্ভব হয়
আর পঞ্চম ভাইয়ার নাম অল-আসার। এর অর্থ উট পড়ে গেলে
খে আওয়াক্রের উদ্ভব হয়।
যায়নের নাম শালশিক্ষ। এর অর্থ ওগলি ফাটলে, যে
যাওয়াক্তের উদ্ভব হয়।
আর সপ্তম জন আমি নিয়ে। আমার নাম নামিত। এর অর্থ হ’ল
মৌনবতী। কম কথা বলার লোক।
আমি যত চুপ করতে বলি নাপিতের বকবকানি ততই বৃদ্ধি
পেতে থাকে। কান একেবারে ঝালাপালা করে দিল। অনন্যোপায়
হয়ে এক নোকরকে ডেকে বল্লাম---আমার চুল ছুঁচার সাধ মিটে
গেছে। ভিক্ষে চাইনে কুত্তা ঠেকা। হতচ্ছাড়া নাপিত টিকে শিকি
বিনার দিয়ে ঘাড় ধরে বের করে দে।
আমার কথায় নাপিতটি গোত্সা না করে বরং মুচকি হেলেই
| বক্তা—হুজুর, আপনি হয়ত ভাবছেন, যে এত অবস্তির কথার
ফুলঝুরি ছোটায় তার নামের অর্থ আবার মৌনব্রতী ? কিন্তু আসলে
| আমি নিজে যেমন বাজে কথার ধার কাছ দিয়েও যাই না তেমনি
কেট বল্‌লে বরদাস্তৎ করতে পারি না।'
মুহূর্তকাল নীরবে ভেবে নাপিত আবার মুখ থুল—'আপনার
কাজ হাসিল করে দেওয়ার জন্যই আমার এখানে আসা। একটি



■ কানাকড়ির প্রত্যাশাও আমার নেই। তা ছাড়া পরিশ্রম বিনা
১ পারিশ্রমিক নেয়াও তো অর্থহীনই বটে। খোদাতাল্লার কাছে এর
জন্য কি কৈফিয়ৎ দেব? তবে আমি এ জন্যই দুঃখিত যে, আমার
দাম আপনি বুঝতেই পারলেন না। একমাত্র আপনার আব্বাজীই
আমার গুণের কদর বুঝতে পেরেছিলেন।
-
একদিনের কথা বলছি হুজুর — আমি তাঁর সামনে উপস্থিত
হওয়া মাত্র পাশে বসালেন। নিজের বাঁ-হাতটির দিকে আমার দৃষ্টি
অকর্ষণ করে বলেন—'আমার এখানটিতে একটি ফোঁড়া হয়েছে।
সামান্য খুনও বেরিয়েছে তা থেকে! জ্যোতিষ, বিচার করে দেখ তো
এতে আমার কোন অমঙ্গল হবে কিনা?
তার অনুরোধে আমি এ জ্যোতিষ-গ্রন্থটি বের করে পাতা উল্টে
এক জায়গায় থামলাম। দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। সূর্যের উচ্চতা পরিমাপ
করে দেখলাম। গণনা করে বল্লাম, সেদিন, সে ক্ষণে খুন ঝরার
জন্য বিপদের আশঙ্কা। বেশ বড় রকমের কোন বিপদই আপনার
সামনে রয়েছে। আমি গ্রহকে বশীভূত করার ব্যবস্থা করছি, ভাববেন
না। আজ বারোটা বত্রিশ মিনিট একুশ সেকেণ্ডে আপনার ফোঁড়াটি
কাটার সবচেয়ে ভাল সময়।
ব্যস। সময় বিচার করে ফোঁড়াটির গায়ে ছুরির আঁচড় মারলাম।
দাওয়াই দিলাম। আপনার আব্বাজী খুশী হয়ে আমাকে স্বর্ণমুদ্রা
ইনাম দিলেন।
আমি খেঁকিয়ে ওঠলাম—‘এতক্ষণ ভেবেছিলাম তোমার মাথায়
ছিটটিট আছে। এখন দেখছি, মাথার মগজ বলে কিছুই আর অবশিষ্ট
নেই। বদ্ধ পাগল ৷’ নাপিত বল— ‘হুজুর, আপনি এখন কামোন্মাদ।



কত ভাববেন না। আামি বিলকুল হেজামত করে দেব। এসব বিদ্যা
আমার খুব ভালই রপ্ত রয়েছে। আল্লাহর একটি বাণীর দিকে
| আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শুনুন-অন্যের দোষত্রুটি মার্জনা
করে, নিজের ক্রোধকে যে প্রশমিত করে রাখে অক্কাতাল্লা তার
গের প্রসন্ন ও সহায় হন।
হুজুর, প্রতিদিন, প্রতিবার নামাজান্তে এলাণী এক শো আটবার
জপ করলে সর্ব বিঘ্ন নাশ হতে পারে। আর আপনার দিবাঙ্গান
প্রাপ্রিও হবে আমাকে যে-সব ঝুটাবাত আপনি বলেছেন তার জন্য
ত্রুটি স্বীকার বা মর্দ্দনা ভিক্ষাও আপনাকে করতে হবে না। করণ,
আমি নিজগুণে সে সব কথা সঙ্গে সঙ্গেই ভুলে গেছি। কিন্তু ভেবে
পাচ্ছিনে, আড্ডা আপনি এমন ক্রোৎপরায়ণ হয়ে পড়ছেন কেন?
আপনার আরাফী কিন্তু সর্বদ! আমার উপদেশ অনুযায়ী
বলতেন—‘গুণীজনের উপদেশ পাগলে যে উৎসাহী হয় তাকে
কোনই বিপদের সম্মুখীন হতে হয় না।' খোদাতাল্লার এ উপবেশামুক্ত
প্রতিনিয়ত জ* করবেন। দুনিয়ায় উপদেশ দেওয়ার লোক ডুবি ডুবি
পাবেন, কিন্তু যোগ্যতা ক'জনের আছে, বলবেন কি? 'আমার তো
মনে হয় তামাম দুনিয়া ঘুরে এলেও আমাকে ছাড়া উপদেশ দেওয়ার
যোগ্য আপনি দ্বিতীয় আর একজন পাবেন না। কেউ পায়ও নি। আর
কথা বাড়িয়ে আপনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। আবার হয়ত
চেঁচিয়ে উঠবেন, নিকাল যাও হিয়াসে। কিন্তু আমাকে দেখছেন তো
কেমন অটুট ধৈর্য। গোশতাব্বা আমাকে এটি উক্রাড় করে ঢেলে
দিয়েছেন। সত্যি বলতে কি, একমাত্র আপনার পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা
• সম্মান-বোধের জন্যই তো আপনাকে উপযাচক হয়ে এতগুলো
উপদেশ দিতে গেলাম। তিনি আজ বেহেস্তে গেছেন বলেই
আপ্নাকে উপদেশগুলি দেওয়া আমার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য
হত করছি। নইলে খোদাতাল্লার কাছে নিজেকে অপরাধী জান
2
আমি উন্মাদের মত চেঁচিয়ে উঠলাম—আল্লাহ, একী মহা সয়ে
পড়া গেল! একী অসহনীয় উৎপীড়ন: তোমার কাছে কাতর মিনতি
খছি প্রামানিক ভাইয়া, আমাকে এবার রেহাই দাও। নইলে গলায়
সাতছা দিয়ে টানতে টানতে সদর-দরজার বাইরে নিয়ে আসব
তোমাকে।'
হায় নসীব আমার। অপমান, ক্ষোভ এবং হম্বিতম্বি কোন
কিছুকেই সে পাত্তা দিচ্ছে, না!
হতচ্ছাড়াটি আবার বলতে শুরু করল—“আমি বুঝছি আপনি
শুষ। আমার প্রতি ঈষৎ উষ্মাও প্রকাশ করছেন। আসলে প্রবীণদের
তো নবীনদের তুলনায় সভা-ধৈর্য একটু আধটু বেশীই ধরতে হয়।
তার আমার আর এখন সবে উম্মার সঞ্চার হয় না। সত্য বলতে
কি, আমি তো বুঝতেই পারছি, পেয়ার মহব্বতে আপনার মাথা এখন



আর ঠিক মত কাজ করছে না। তবে ইলাজ করলে, ঠিকঠাক দাওয়াই
দিলে আপনার বিমারি সারতে বাধ্য। ভাববেন না, আমিই দাওয়াই
দিয়ে নিরাময় করে তুলব। অগ্ধ মনে পড়ছে, আপনি যখন গুড়া
বাচ্চা ছিলেন তখন মঞ্চত্রে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসার সময় কত
অত্যাচারই না আপনি আমার ওপর করতেন, সে সব মনে আছে?'
আমি গুলি যাওয়া শেরের মত গর্জে উঠলাম—'পরামানিক
ভাইয়া, মেহেরবানি করে এবার ছাড়ান দাও। আমার হাতে অনেক
কাজ। চুল ছাঁটাই আক্রফ্রকের মত শিকেয় তুলে রাখছি। আর যদি
দেহাই'—কথা বলতে বলতে আমার গায়ের পশমী আলোয়ানটি
ক্যাস্ করে দু' টুকরো করে ফেল্লাম।
নাপিতটি এবার কেমন একটু ভড়কে গেল। মুহূর্তে নিজেকে
সামলে নিয়ে ক্ষুর হাতে আমার দিকে এগিয়ে এল। আমার মাথাটিকে
তার দু ইট্রির ফাকে আঁকড়ে ধরে মাথায় ক্রূর চালাতে লাগল।
সামান্য একটু জায়গায় ক্ষুর বুলিয়ে আবার তার বক্তিমে শুরু করল
—'আসল কথা কি করেন? চাঁধে শয়তান না ঢাগলে অধৈর্যের
উদ্ভব হয় না, থাক গে, আর কিছু বলব না। কারণ, আমার প্রতি
আপনার মনে তো কিছুমাত্র আস্থা নেই।'
—‘দোহাই তোমার পরামানিক ভায়া! আমার হাতে সময় খুবই
কম।
—হ্যাঁ, এবার বুঝলাম বটে, আপনার সময়ের খুব অভাব। কিন্তু
কে বলেছে, 'আপনার সময়ের খুবই অভাব? হতেই পারে না। কোন্
হতচ্ছাড়া জাপনাকে তাড়াহুড়ো করতে বলেছে? দরকার হলে
আমিই বলব, কখন তাড়াতাড়ি যেতে হবে, কখন পক্রি করতে হবে
ধীর-মজুর। অহেতুক ব্যক্ততার ফলে কিন্তু ক্ষতির বোঝাই বইতে
হবে। আমাদের পীর-মহম্মদের বক্তব্য কি জানেন কি? দুনিয়ায় বা
কিছু খুবসুরৎ সবই ধীরে সম্পন্ন হয়েছে। ভাই বলছি কি, ঝোন
কালেই ব্যস্ততা প্রকাশ করা সঙ্গত নয়। আপনার ব্যস্ততার কথা
জানতে পারলে মুল্যবন কিছু উপদেশ দিতে পারতাম। আমার
কথায় আবার যেন গাল ফুপাবেন না। আপনার সামনে খুবই সুসময়,
দিব্য চোখে দেখছি।'
ব্যস্, চুলছাটা এ পর্যন্ত রয়ে গেল। সে তার জ্যোতিষীর কতবটি
খুলে বলল। সূর্যের আলোয় মেলে ধরে কি সব ছহিপাশ দেখতে
লাগগ নিবিষ্ট চিত্তে।
এক সময় আমার দিকে খাড় ঘুরিয়ে বলল- কি সব বাঙ্গে কথা
বলেন যাদের মাথামুণ্ডু নেই। কই, আপনার ব্যস্ততার কথা তো
উল্লেখ দেখছি না। আমার গণনায় ভুলচুক হবার জো নেই। দুপুরে
| নামাজের সময় আপনার কাজ করার পক্ষে উপযুক্ত সময়। তার
আগে ব্যস্ত হয়ে কোন ফল পাবেন না। অন্ততঃ তিন ঘণ্টা অনায়াসে
শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিতে পারেন।'


আমি এবারও দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে বলে
উঠলাম—'বাপু, সত্যি আমি আর পারছি না। এবার রেহাই দাও!
সে এবার আর কোন কথা না বলে আলতো করে ক্ষুরটি তুলে
নিয়ে আমার মাথায় চালাতে লাগল। খুবই সামান্য অংশ কামন্দ।
বুঝলাম, ইচ্ছে করেই ধীর হাতে ক্ষুর টানছে।
ব্যস, আবার তার কিস্সা শুরু করঙ্গ—'হুজুর, আপনার ব্যস্ততা
সত্যি আমাকে বিমর্ষ করে তুলেছে। আপনার ভাব্বাজী আমার
পরামর্শ অনুযায়ী চলতেন তা তো জানেনই। আপনিই যদি—'
তাকে থামিয়ে দিয়ে বল্লোয়--'আজ নামাজের সময় আমাকে
আমার মেহবুবার বাড়ি যেতে হবে। নামাজ শেষ হবার আগে
পালাতে হবে। নইলে তার বাবার খপ্পরে পড়তে হবে। তারপর এফ
বন্ধুর বাড়ি গিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজনের নিমন্ত্রণ সারম্ভে হবে। তাই
তোমাকে আবারও অনুরোধ করছি, একটু হাত চালিয়ে চুলটা হেঁটে
আমাকে ছেড়ে দাও!
—'ছায় খোদা। তাই তো, আমার তো বাজারই সারা হয় নি।'
—'তোমাকে আর বাজারে যেতে হবে না। আমার
বাড়িতেই-গোস্ত আর সরাব আছে খানাপিনা সেরে যেয়ো। একটু
হাত চালিয়ে আমায় চুল হেঁটে দাও বাপু।'
—চমৎকার কথা! কি কি পাকাক হয়েছে মেহেরবানি করে
বলবেন কি হুজুর?'
—“বিরিয়ানি, দো পিঁয়াজী, গোল্ডের চপ, হ্বার গোল্ডের
বটি---তোমার মা-া দরকার নিয়ে যাও।'
—'একটু চেখে দেখার সুযোগ করে দেবেন হুজুর?’
রসুইকরতে গিয়ে সব রকম থানা একটু একটু করে তার চেখে
দেখার জন্য আনিয়ে দিলাম। সরাবও দিলাম এক বোতল।
সে সব কটি বাটি থেকে একটু একটু করে চেখে দেখে বলল
—'আপনার মত এমন পরাজ মন আর ক'জনের আছে।"
—“ঠিক আছে। এবার আমার চুল ছাঁটার ব্যাপারটি শেষ কর।
অামার বেরোবার সময় হয়ে এসেছে।'
এবার ক্ষুরটি সে হাতে তুলে নিল। বার দু'-তিন আমার মাথায়
সেটি বুলিয়ে নিয়ে আবার তার পাঁচালি জুড়ে দিল। 'আজকে
আপনার কাছ থেকে যে ঔদার্যের পরিচয় পেলাম তারজন্য ধন্যবাদ
জনংসে তা আপনার আব্বাজীকেই জানাতে হয়। কারণ, আপনার
যা কিছু স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সবই তো উত্তরাধিকার সূত্রে
আপনার আব্বাঙ্গীর কাহ্ থেকেই পেরেছেন।
-
তারপর এক সময় নাপিত বলল—'হুজুর, আমার ঘরে আসুন
না একবারটি। খানাপিনা আর নাচগানের আয়োজন করা যাবে।
মেজাক্ত শরিফ হয়ে যাবে। কাজকর্ম যা কিছু হাতে রয়েছে সেরে
একটু রাত্রি করে এলেও চলবে। আমি বলছি, খুব আনন্দ পাবেন।



কারণ, বহুত জ্ঞানী-গুণীজনের সমাবেশ ঘটবে।
আমি রেগেমেগে বল্লাম—'তুমি তোমার জ্ঞানী-গুণীদের
। নিয়ে থাক গে। আমার দরকার নেই। তুমি মেহেরবানি করে আমার
চুল ছাঁটার কাজটুকু সেরে দাও, তা হলেই কৃতাৰ্থ হ'ব।'
“ঠিক আছে, তাড়াতাড়িই সেরে দেব। আমি খানা আর সরাব
টরাব এক দৌড়ে বাড়িতে রেখে আসি গে।'
আমি রীতিমত গর্জে উঠলাম—‘বাজে ধান্দা রাখ! আগে আমার
চুল ছেঁটে দাও। তারপর তুমি জাহান্নামে যাও, দেখতে যাব না। আগে
আমার কাজ—'
—‘একা? একা যাবেন? আপনাকে একা ছাড়তে কিছুতেই দিল
আমার সরছে না।'
আমার কোন কথাই সে পাত্তা দিল না। অধৈর্য প্রকাশ
করলাম—কী করছ তুমি! আমি যে তখন থেকে বলছি আমার তাড়া
আছে কানেই ঢুকছে না তোমার!’
—‘ভাল কথা তো। তাড়া যখন আছে তখন তাড়াতাড়িই তো
যেতে হবে। কিন্তু আমি বলছি কি, বাগদাদ নগর তো আর এই
এতটুকু নয় যে, যেখানে খুশী একা একা চলে যাবেন। এখানে পায়ে
পায়ে বিপদ জড়িয়ে থাকে।'
—‘রাখ তো তোমার প্যানপ্যানানি! আমার চুল ছেঁটে দিয়ে
মানে মানে বিদায় হও।
সে এবার ব্যস্ত হাতে ক্ষুর চালাতে লাগল। হায় আমার নসীব!
চুল ছাঁটা শেষ হলে দেখি নামাজের সময় পেরিয়ে গেছে, রাগে-
দুঃখে আমার মাথায় খুন চাপার জোগাড় হ'ল।
নাপিত আমার দেওয়া খাবারদাবার ও সরাবের বোতল নিয়ে


বাত্ত্বির দিকে হাঁটা জু
ব্যস, আর এক মুহূর্তও দেরী নয়। এক দৌড়ে হাজির হলাম
কাজীর বাড়ি। দরজা খোলাই রয়েছে দেখলাম : ঘরে ঢুকে সরঞ্জটি
স্লিাম বন্ধ করে। সে বুড়ি ভেতরেই রয়েছে দেখলাম।
বাড়ির বাইরে কিসের যেন চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলাম।
মনে খটকা লাগল। আমি দৌড়ে আনার সময় কিছু লোক আমার
দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিল! হয়ত চেরটোর ভেবে
থাকবে। তারাই হয়ত পিছু নিয়েছে। কাজীর বাড়ি চুরি করতে
ঢুকেছি অনুমান করেছে!
আমার মেহবুবা জানালার ছিত্রে চোখ রেখে দেখল, কাজী
ক্ষরের পিঠ থেকে নামছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছে হতচ্ছাড়া সে
নাপিতটি। আর বষ্কারজন লোকও সঙ্গে রয়েছে।
শুনে তো আমার গলা পর্যন্ত শুকিয়ে একেবারে কাঠ। আমাকে
অভয় দিতে গিয়ে আমার পিয়ারী, আমার মেহষুণা বল্গ–
ছাড়াচ্ছ কেনা আমার আব্বাজান সচরাচর আমার ঘরে আসো
হতচ্ছাড়া নাপিত যখন নিঃসন্দেহ হ’ল আমি ইতিমধ্যেই বাড়ির
ভেতরে ঢুকে পড়েছি তখন সে গাছেড়ে বিলাপ জুড়ে
দিল আমার কী সর্বনাশ হ'ল গে! তোমরা কে আহ, আমার
মনিবকে বাঁচাও! কাজী সাহেব তাকে খুন করে ফেলেন! খুন।
কাজী সাহের জামার মনিবকে খুন করে ফেললেন!’ কাঁদতে কাঁদতে
সে দু' হাতে নিজের পায়ের জোক্সটি ছিড়েছুঁড়ে একাকার করে
ফেল্ল। আর নিজের চুল ছেঁড়ার অভিনয় করতে লাগল।
কৌতূহলী পথচারীরা নাপিতের চারদিকে ভিড় করে দাঁড়াল।
ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করল।
নাগিত তো কেঁদেকেটে একসার–আমার মনিব কাজীর বাড়ি
ঢুকে পড়েছেন। কাজী তাকে গ্রুেপেটা করছেন। তোমরা সবাই
আমার সঙ্গে বাড়ির ভেতরে চল: কেন তিনি আমার মনিবকে এমন
বে.ধড়ক পিটছেন, জিজ্ঞেস করি দে।'
প্রচারীরা রেগে কাঁই হয়ে গেল। কালী ক্ষমতাবান বলে একটি
লোককে আহতুক মারধোর করবেন তা তো হতে দেওয়া যায় না।
নাপিতের সঙ্গে সবাই হুড়মুড় করে বাড়ির ভেতরে ঢোকার
• উদ্যোগ নিল। দরজার কড়া নাড়তে শুরু করল।
ব্যাপার দেখে কাজী বেচাৱা তো হতভম্ব। এক নিগ্রো নফর
রজা খুলে দিল। পথচারীরা বেজায় চিৎকার জুড়ে দিল। কিন্তু কি
যে বক্তন! বোঝা গেল না।
নাপিত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল—'কাঙ্খী সাহেব, আপনি
আমার মনিবকে মারধোর করছেন কেন? তার অপরাধ কি?'
—ব্যাপার কি, কিছুই তো আমি বুঝছিনা। কে তোমার মনিব ?


কাকেই বা আমি মারধোর করলাম? খোল্সা করে বল তো, কি
হয়েছে?'
–‘হবে আবার কি, নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোলে কি আর
সব কিছু টের পাওয়া যায়? সব খোয়া গেল আপনার।'
কাজী গর্জে উঠলেন—'বাজে কথা রেখে সত্যি করে বল,
ব্যাপার কি? বাছা, তোমার মনিবটি কে? আমার বাড়িতেই বা তার
কি দরকার?'
-
——‘হাসালেন কাজী সাহেব! তামাম দুনিয়ার লোক জানে আমার
মনিবের সঙ্গে আপনার লেড়কির ইয়ে, মানে পিয়ার মহব্বত
রয়েছে। আর আপনি জানেন না, বিশ্বাস করতে হবে আমাকে!
রোজ, আপনার বাড়ি তিনি তো রোজই আসেন।'
—‘সে কী কথা ! আমার লেড়কির নামে এরকম বদনাম ! আমি
কিছুতেই বরদাস্ত করব না।'
—‘এখন আর বরদাস্ত না করে উপায় কি, বলুন? গোড়ায়
দিলেন আস্কারা। আর এখন লাগাম টেনে ধরলে চলবে কেন? সব
জেনে শুনে না জানার ভান করলে কি আর ব্যাপার থেমে থাকবে?
আগেই নিজের লেড়কিকে সতর্ক করা উচিত ছিল। শুধু আমি কেন,
এই যে এত লোক এখানে জড়ো হয়েছে, জিজ্ঞেস করুন, একই কথা
সবাই বলবে।'
-
কাজী সাহেব তার লেড়কির চরিত্র নিয়ে এরকম জঘন্য সব
কথাবার্তা শুনে রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
পথচারীদের কোলাহল নতুন করে শুরু হ'ল। তারা চেঁচিয়ে
বলতে লাগল—'আমরা মকানটি তল্লাসী করে দেখতে চাই। এর
মনিবের কি দশা করা হয়েছে।'



আমি প্রমাদ গল্লাহ। এবার সবাই যদি হুড়মুড় করে বাড়ির
ভেতরে ঢুকে পড়ে আর গানাতল্লাসী শুরু করে তবেই কম্ম ভ্রুতে।
আমার মেহবুবা একটি কাঠের বাক্সের মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে
বন্ধ করে দিল। আমি লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলাম।
দরজা তুলে দিতেই সবাই হুড়োহুড়ি করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে
গেল। সব ধর, ধারণা, গলি প্রভৃতি আতিপাতি করে খুঁজল।
কোথাও কাউকে না পেয়ে আমার মেহবুবার ঘরে এল। তা ও
আমাকে পেল না। সবাই হতাশ হয়ে ফিরে গেল। পূর্ত নাপিত হাল
ছড়ঙ্কনা। কাঠের বাকটির কাছে এসে দাঁড়াল। বাক্তের ডালটি যাক
করল। আমার চোখে চোখ পড়তেই, দম্ করে ডালাটি বন্ধ করে
ছিল।
আমি বুঝলাম, নাপিত এবার আমাকে সামেত বান্ধটি সাধায়
তুলে নিল। রাস্তায় এসে হাম্রটিকে দম্ করে ফেলে দিল। বান্সের
ভাষাটি গেল খুলে। আমি রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়লাম। তখনই
আচমকা চোট লেগে আমি পা টি হারাই! খোঁড়া হয়ে যাই। সেখান
থেকে উঠে তাড়াতাড়ি একটি গুলির মধ্যে ঢুকে পড়ি। আমাকে আর
বেগম শাহরাজাদ দেখলেন, ভোর হয়ে এº বলে। তিনি কিস্সা
বন্ধ করলেন। বাদম্পই শানিয়ার নিজের কাজে চলে গেলেন।
ত্রিশতম রজনী
রাত্রি গণ্ডীর হলে কদশাহ শরিয়ার অন্দরমহলে বেগম
শহরাজাদ-এর কামরায় এলেন।
কোনরকম ভূমিক’ না করেই বেগম শহরলক্তাদ তাঁর কিত্সা শুরু
করতে গিয়ে বললেন—জাহাপনা, সেই দাউটি তার কিস্সা বলে
চল্ল – খোঁড়াটি ভোষের আসবে তার জীবনের করুণতম
অধ্যায়ের কথা বলছে। উপস্থিত সবাই অভ্যর্থ আগুঙ্গে সঙ্গে আনতে
কাতাল!
আমি তো পলির মধ্যে ঢুকে কোনরকমে জানটি বাঁচালাম। তবু
আমি দৌড় বন্ধ করলাম না। নাপিত আমার পিছনে আঠার মত
লেগে রইল। দৌড়োতে দৌড়োতে সে চিৎকার করে বলতে
লাগল—‘হুজুর, একটু থামুন। আমার কথা শুনুন। এখন স্বীকার
হেন তো আমিনা থাকলে আপনি ভানে বাঁচতেন না। আপনাকে
তো আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম, আমাকে সঙ্গে না নিয়ে মেটেই
পা-বড়োবেন না। তবু অনুমানের ওপর নির্ভর করে এসে না পড়লে
কী কেলেমারী হয়ে যেত, ভেবে দেখেছেন? এখন আর দৌড়োবার
দরকার নেই। দাঁড়ান।
নাপিত আমার কাছাকাছি চলে এলে হাঁপাতে হাঁপাতে
বল্লাম—'ভাই, আমকে এবার অন্ততঃ রেহাই দাও। আমার পিছু
ছাড়। দোহাই তোমার, আমাকে একটু দম ফেলে বাঁচতে দাও তুমি



কি আমার জান খতম না হওয়া পর্যন্ত আমার পিছন ছাড়ছ না?'
অ'মি আবার দৌড়ে এক দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম
দোকানিকে বল্লাম, আমাকে আপনার দোকানের ভেতরে একটু
লুকিয়ে থাকার সুযোগ নিন। আমার খুবই বিপদ। পরে সব খুলে
বলছি আপনাকে।'
বোকানি কি বুঝল, কে জানে? তার আলমারির পিছনে আমাকে
লুকিয়ে থাকার সুযোগ দিল।
সহ শুনে দোকানি আমাকে বল্ল – 'তোমার পা না সারা পর্যন্ত
এখানেই থেকে যাও। আমার দোকানে নাপিতের মত কোন
বদমায়েস লোকই ঢুকতে পারবে না।'
এবার থেকে নাপিতের ওপর বিরক্তির পরিবর্তে আমার মনে
ভীতি মিশ্রিত কৃপার সঞ্চার হ’ল। মনস্থির করে ফেলাম মুলুক
ছেড়েই চলে যান। এরকম বদমায়েশ লোক যখন পিছনে লেগেছে
ভগ্ন অ'র এ মুলুকেও থাকছি না। খেদাতাত্মার কাছে প্রার্থনা করছি
নাঞ্ছার নাপিতের বংশ নিপাক্ত যাক।
আমার ব্যবসাপত্র যা ছিল সব সম্ভা লয়ে ঝেড়ে দিলাম। সামান্য
জমিজঙ্গ যা ছিল তা আমার এক অভিন্ন হৃদয় বন্ধুকে তারকির ভাব
দিয়ে দিলাম। ৰাস, হারা উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। সাগর
মহাসাগর, পাহাড়, মরু পেরিয়ে বহু মুল্লুক ঘুরে হাজির হলাম
অপপ্নর দেশে। মুলুক চীনদেশে। ভাবলাম, আর কিছু না হোক
অন্ততঃ আমার শনি সে-শাসিতের পাল্লায় আর পড়তে হচ্ছে না।
কিন্তু নীরেন্দ্র ফের, এখানে এসেও সাক্ষাৎ সে-যমটির খপ্পরে
পড়তে হ'ল। আবার পালিয়ে যাওয়ার ফিকির খুঁড়তেই হ’ল।
কথাটি বলেই সে হয় ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
নাণিত করুন নিতপ্ত রূপ্রার্থীর মত বিষণ্ণ মুখে বসে রইল।
ভামরা তাকে জিজ্ঞাশ করপ্রম—'এমন একটি নিরীহ-নিরপরাধ
যুবকের জিন্দেগী ব্রবাদ করার ধান্দা করছ হেন হে
—অাপনারা কিন্তু আমার প্রতি অবিচারই করছেন। অমি তার
ভাল ছাড়া ফন্দ করার চিন্তা করি নি। আমার পরামর্শ অনুযায়ী চল্‌লে
তাকে এরকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হ'ত না। আর
তার পায়ের কথা যদি বলেন আমি বলব একটি পা গেছে কিন্তু জান
রক্ষা পেয়েছে। সেদিন আমি কৌশল প্রয়োগ না করলে অবশ্যই
তাকে জান পোয়াতে হত। কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে সে কিন্তু আমাকে
অভিশাপই দিয়ে গেল যাক গে, খোদাতাল্লা এর বিচার করবেন।
আপনারা তো আমাকে দেখছেন। অমি কি অনাবশ্যক কথা
বলি, নাকি বিবেকহীনের মত কোন কাজ করেছি? তবে আমার ছয়
ভাই ক্ষমতা রাখে বটে! আপনারা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝবেন,
আমার জ্ঞান কত গভীর।
আপনার| তো জানেন, বাগদদি আমার স্বদেশ। আমি দেশ ছেড়ে


জাসার সময় সে-দেশের সুলতান ছিলেন অল-মাসতানাসির বিল্লাহ।
| ধার্মিক প্রকল্প বলে তাঁর যথেষ্ট খ্যাঙি। তাঁর সুলতালিয়তে জ্ঞানী-
গুণীদের খুবই কার ছিল।
পলিফার কাছে একবার খবর গেল, নগরের প্রান্তে দশক্ষন
সমাও-বিরোধীর এক আখড়া রয়েছে। সুখবরটি শোনামাত্র সুলতান
সিপাহীদের কড়া নির্দেশ দিলেন তাদের বন্দী করে কয়েদখানায়
পুরে দিতে।
আমি এক বিকেলে টাইগ্রিস নদীর ধার দিয়ে সান্ধ্য-ভ্রমণ
সারছিলাম। এমন সময় দেখি, নৌকায় দশজন লোক বসে। নোঙর
তোর উদ্যোগ নিচ্ছে। ভাবলাম এরা নদীপথে সাদা-ভ্রমণে
বেরোচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে তাদের নৌকোয় উঠে পড়লাম।
আমি তো বলেছিই, আমি মিতভাষী। নিতান্ত দরকার ছাড়া মুখ গুলি
না। তাই তাদের অনুমতি না দিয়েই দৌকোয় উঠে গেলাম। সঙ্গে
নোঙর ভূলোচ্ছে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে একদল সদা পোশাক পরিহিত
সিপাহী অতর্কিতে নৌকাটিকে ঘিরে ফেল্ল। আমাকে সহ সবাইকে
হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হ’ল। হার্জির করল সুলতানের
খলিফা সবকিছু গুনে বাজখাই গলায় গর্জে উঠছে—যাও,
এদের বা ভূমিতে নিয়ে যাও। দশজনকে একের পর এক কোভল
কর।' আমি তো মিশুভার্থী, একটি কথাও বল্লাম না।
জল্লাদ তার সুতীক্ষ্ণ অস্ত্র দিয়ে এক এক করে দশজনের গর্দান
নিল। বধ্যভূমি খুলে মাখামাখি, আমি এক কোপে চুপচাপ দাঁড়িয়ে
শেষবারের মত আল্লাতামাকে স্মরণ করতে লাগলাম।
জল্লাদ এবার হাতের অস্ত্রটি পাশে নামিয়ে রাখল। সুলতান
সবিস্ময়ে বললেন—'এ কী রকম কাজ হে? একজন যে বাকি রয়ে
"
জল্লাদ কুর্নিশ করে জবাব দিল-'হুজুর, আপনার আদেশ মতই
কাজ হয়েছে। গোল্তাকী মাফ করবেন, আপনি দশজনকে কোতল
রাতে বলেছেন : আপনি গুণে দেখুন, দশটি লাশ আর দশটি শির
এখানে আছে কিনা।
সুলতানের মনে আছে, দশজনকে কোতল করতে চকুম দেওয়
হয়েছিল। সে ছকুম যথাযথভাবে পালিত হয়েছে।
আমাকে নিয়ে সুলতানের মুখোমুখি দাঁড় করানো হ'ল। তিনি
সবিস্ময়ে বললেন—'কে তুমি? মকান কোথায়? এ সমাজ-
বিরোধীদের দলে ভূমি ভিড়লে কি করে?
আমি তো কথা কম বলি। কিন্তু এবার মুখ তুলতেই হল।
বলাম—'জাঁহাপনা, আমি কথা খুব কম বলি ব'লে সবার কাছে
অমি 'সীমিত' বলে পরিচিত। আমি কথা কম বলি বলে আপনি
জল্লাদকে ভুল হুকুম করেছেন বুঝেও মৌন হয়েই ছিলাম। কারণ,


S
[{\\
প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। তাছাড়া অন্যের
ব্যাপারে অহেতুক মাথা না ঘামানোও আমার একটি বড় গুণ। আমার
পুরুষানুক্রমিক ব্যবসা ক্ষৌর-কাজ। আমাকে নিয়ে সাত ভাই
আমরা। আর আপনি জানতে চেয়েছেন, সমাজবিরোধীদের দলে
আমি কি করে ভিড়লাম! ট্রাইগ্রিস নদীর তীর ধরে বেড়াবার সময়
দেখলাম, এ-দশজন লোক নৌকো নিয়ে নদীতে বেড়াতে যাচ্ছে।
নিঃশব্দে নৌকোয় উঠে পড়লাম। আপনার সিপাহীরা তখন নৌকো
ঘেরাও করে আমাকে সহ সবাইকে বন্দী করে হাজির করে আপনার
দরবারে। তখনই আমি বুঝেছিলাম, লোকগুলো মৌনব্রতী। আমিও
তো কথা কম বলি, তাই মৌন হয়েই ছিলাম।
আপনি জল্লাদকে হুকুম করলেন কোতল করতে। আমি অসীম
ধৈর্যের পরিচয় দিলাম। টু-শব্দটিও করলাম না। আমি তো নিঃসন্দেহ
যে, খোদাতাল্লা নিশ্চয়ই আমাকে রক্ষা করবেন।
আমার আচরণে, বিশেষ করে কথাবার্তায় সুলতান আমার ওপর
খুবই প্রসন্ন হলেন। হবে নাই বা কেন? আমার মত মিতভাষী,
বিদ্যান, বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ ও সাহসী ব্যক্তি তো সচরাচর দেখাই যায়
না।
নাপিত এবার বল্ল—'আপনারা তো একটু আগেই নিজ কানে
শুনলেন খোঁড়াটি আমার নামে কি সব মিথ্যা, বদনাম দিয়ে গেল।
আমার জন্যই নাকি তাকে পা-টি হারাতে হয়েছে।'


সুলতান অত্যুগ্র আগ্রহ প্রকাশ করে আমাকে বললেন— 'আচ্ছা
মিঞা, তুমি একটু আগে তোমার ছয় ভাইয়ার কথা বলেছ। তারা
কি তোমার মতই বিদ্যান, বুদ্ধিমান, সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলাম—'না জাঁহাপনা, মোটেই
না। আমার সঙ্গে আমার ভাইয়াদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ
আলাদা। আশমান-জমিন ফারাক যাকে বলে। তাদের সঙ্গে আমার
ভুলনা করে আমাকে কিন্তু ছোটই করলেন। তারা সব ব্যাপারেই
একেবারে আনাড়ী। নিরেট মূর্খ, একেবারে হদ্দবোকা। অপরের
ছিদ্রান্বেষী, পরশ্রীকাতর, আর হীন মনের ধারক আমার
ভাইয়াগুলো। তাদের চেহারার মধ্যেও যথেষ্ট খুঁত দেখতে পাবেন।
একজন কানা, একজন স্ল্যাংড়া, একজন অন্ধ—–দু’ চোখই খুইয়েছে,
কারো মুখ পোড়া, কেউ কালা–কানে একেবারেই শোনে না, আর
একজনের তো নাকই নাই।'
নাপিত এবার বল্ল—জাঁহাপনা, আমার গুণবান ভাইয়াদের
কথা এক এক করে বলছি। আশা করি আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য থেকে
তাদের সম্বন্ধে আপনি সম্যক ধারণা করে নিতে পারবেন। জাঁহাপনা,
আমার বড় ভাইয়ার নাম বাকবুক। সে ল্যাংড়া। তার এরকম
নামকরণের কারণ, সে সর্বদা মুখে এমন এক আওয়াজ করে যা
বাস্তবিকই অদ্ভুত। কানায় কানায় ভর্তি কলসি থেকে জল ঢালার
সময় যে আওয়াজের উদ্ভব হয় ঠিক সে রকম আওয়াজ সে সর্বদা
মুখ দিয়ে করে থাকে।